কামরুল ইসলাম হুমায়ুন ও মো. সাফায়েতুজ্জামান
‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কোরআন মাজীদের প্রথম অনুবাদক নন, তিনি ছিলেন প্রকাশক। একটি ভুল প্রচারের নিরসন’— শিরোনামের একটি পোস্ট ফেসবুক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের অনেকেরই চোখে পড়েছে। সত্যি বলতে কি, যথেষ্ট কৌতূহল জাগানিয়া একটি ব্যাপার এই বিষয়টির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে, কারণ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই যে সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেছেন, এতোদিন আমরা এ কথাই শুনে এসেছি। এমনকি বই-পুস্তকেও একই কথা লেখা রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এটিকে একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয় হিসেবেই এতোদিন আমরা জেনে এসেছি। তাহলে হঠাৎ করে কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, রাতারাতি পুরো ইতিহাসটাই বদলে গেলো! আজ আমরা সে রহস্যেরই দ্বার উন্মোচন করতে চেষ্টা করবো।
আলোচ্য পোস্টটির শুরুতেই বলা হয়েছে— “সর্বপ্রথম ১৮০৮ সালে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের আংশিক অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এরপর বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন মৌলভী নাঈমুদ্দীন ১৮৩৬ সালে। গিরিশচন্দ্র সেন শুধু উক্ত অনুবাদকে পুস্তক আকারে সন্নিবেশ করেছেন, গিরিশচন্দ্র হচ্ছেন প্রকাশক। তাও অনেক পরে, ১৮৮৬ সালে। সুতরাং কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র নন, বরং মৌলভী নাঈমুদ্দীনই পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক। আর মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া হলেন বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন শরীফের আংশিক অনুবাদক। গিরিশচন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৩৫ সালে এবং মৃত্যু ১৯১০ সালে। গিরিশচন্দ্রের জন্মেরও আগে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে কুরআন শরীফের বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেন মাওলানা আমীরউদ্দীন বসুনিয়া।”
প্রথম কথা হলো— ইতিহাস থেকে জানা যায়, আমীরউদ্দীন বসুনিয়ার এই আংশিক অনুবাদটি শুধুমাত্র ‘আমপারা’ অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা জানি, পবিত্র কুরআনের শেষ পারা অর্থাৎ ৩০তম পারা ‘আমপারা’ নামে সমধিক পরিচিত। এমনকি, আমীরউদ্দীন বসুনিয়ার এই অনুবাদটি ছিল মূলত দোভাষী বাংলা তথা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় রচিত; সোজা কথায় এটি ছিল আমপারার একটি কাব্যানুবাদ বা পদ্যানুবাদ। সে অর্থে আমীরউদ্দীন বসুনিয়ার অনেক আগেই মধ্যযুগের একজন খ্যাতনামা কবি— শাহ মুহম্মদ সগীর (আনুমানিক ১৪শ-১৫শ শতক) তাঁর ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যের মধ্য দিয়ে ‘সূরা ইউসুফ’-এর অনুবাদ করতে সক্ষম হন এবং এটিই ছিল বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন অনুবাদের প্রথম দৃষ্টান্ত। তাই তাঁকে বাংলায় কুরআন অনুবাদের পথিকৃৎ বলা হয়। অতএব একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আমীরউদ্দীন বসুনিয়া নয় বরং পবিত্র কুরআনের আংশিক অনুবাদের পথিকৃৎ হলেন মধ্যযুগের খ্যাতনামা কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, আর আমীরউদ্দীন বসুনিয়া হলেন আমপারা অংশের প্রথম অনুবাদক।
পোস্টটিতে আরও দাবি করা হয়েছে— ‘এরপর গিরিশচন্দ্র সেনের জন্মের একবছর পরই অর্থাৎ ১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মৌলবী নইমুদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩২ মতান্তরে ১৮৩৮ সালে! তাহলে কিভাবে তিনি ১৮৩৬ সালে কুরআনের অনুবাদ করলেন? কৌতুকের বিষয় হলো, পোস্টের কোথাও কিন্তু মৌলবী নইমুদ্দীনের জন্মসাল সম্পর্কে কোনো প্রকার তথ্য নেই! আর এখানেই মূলত রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি! যাই হোক, এ সম্পর্কিত দলিল-প্রমাণগুলো এখন একে একে তুলে ধরছি।
বাংলা একাডেমীর ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা— টাঙ্গাইল জেলা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মৌলভী মোহাম্মদ নঈম উদ্দিন ১৮৩২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সুরুজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উপমহাদেশের মুর্শিদাবাদ, এলাহাবাদ, জৈনপুর, বিহার, আগ্রা, দিল্লি, প্রভৃতি স্থানের দেশবরেণ্য বিখ্যাত আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদের নিকট থেকে ইলমে শরীয়ত ও ইলমে মারেফাত বিদ্যা আয়ত্ত করেন।’ (পৃষ্ঠা-৬০)
বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান-এ বলা হয়েছে— ‘মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন।। জন্ম সুরুজ গ্রাম, টাঙ্গাইল, ১৮৩২। মুসলিম শাস্ত্রবেত্তা, ইসলাম প্রচারক, লেখক।’ (পৃষ্ঠা-৪৪০)
লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’-তে উল্লেখ করেছেন—‘যে সকল লেখক মুসলমান-শাস্ত্র চর্চা দ্বারা আমাদের মুসলমান সমাজের বহু কল্যাণ সাধন করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে মৌলভী নঈমুদ্দীন সাহেবের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত সরুজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।’ (পৃষ্ঠা-৩২৬)
উল্লেখ্য যে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল (অন্যান্য ছয় প্রতিবেশী জেলাসহ ময়মনসিংহ জেলা) ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক ময়মনসিংহ জেলা হিসাবে গঠন করা হয়েছিল। পরে, এটিকে ছয় জেলায় ভাগ করে দুই দফায় পুনর্গঠিত করা হয়। জেলাগুলি হলো— ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল ও শেরপুর।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মোফাখ্খার হুসেইন খান তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ’-তে উল্লেখ করেছেন— ‘একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, তার্কিক, ওয়ায়েজ ও আবেদ নঈমূদ্দীন ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র রোকনউদ্দীন আহমদ কর্তৃক পরিবেশিত খানদানী কুরছীনামা থেকে পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী মৌলভী নঈমূদ্দীনের পূর্বপুরুষ শাহ সৈয়দ মুহম্মদ খালেদ বাগদাদ থেকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমন্ত্রণে দিল্লী আগমন করেন। সৈয়দ সাহেবের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ সৈয়দ মুহম্মদ তাহের শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। এ দেশে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি মানিকগঞ্জের গালা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। পরে, তাঁর অধস্তন পুরুষেরা সৈয়দ উপাধি ত্যাগ করেন এবং টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার দারাকুমুল্লী, মীর্জাপুর উপজেলার বানিয়াপাড়া এবং টাঙ্গাইল থানার শুরুজ (সুরঞ্জ) গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকেন। মৌলভী নঈমূদ্দীন এই শুরুজ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন।’ (পৃষ্ঠা-৫৫)
উল্লেখ্য যে, উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়াতেও নইমুদ্দীনের জন্মসাল ১৮৩২ খৃষ্টাব্দ বলা হয়েছে। তবে কোনো কোনো গবেষকের মতে মৌলবী নইমুদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৮ সালে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ (পৃষ্ঠা-২৯০) এবং অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’ (পৃষ্ঠা-৬৯)-এর টীকাতে উল্লেখ করেছেন যে, “কবি আবদুল কাদির কৃত ‘মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন’ শীর্ষক বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, ৩য় বর্ষ, ১৩৬৬ সাল, বৈশাখ-শ্রাবণ সংখ্যা অবলম্বনে নঈমুদ্দীনের জন্মসন ১২৩৮ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৮৩২ খৃষ্টাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে তাঁর সমসাময়িক শেখ জমীরুদ্দীন ‘ইসলাম প্রচারক’ ১৯০১ সাল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় তাঁর জন্ম ১২৪৪ মোতাবেক ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দ বলে নির্দেশ করেছেন। প্রবন্ধটি নঈমুদ্দীনের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় বলে এতে ভুলভ্রান্তির অবকাশ কম। কারণ ভুল থাকলে তিনি স্বয়ং এর প্রতিবাদ করতেন। এখানে তাই আমরা শেষোক্ত তারিখ গ্রহণ করছি।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত, মোঃ আবদুল করিম রচিত ‘ময়মনসিংহ জেলায় ইসলাম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে— ‘যেসব বরেণ্য আলিম বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম ও দাওয়াতী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ নইমউদ্দীন অন্যতম। তিনি ১৮৩৮ সালে টাংগাইল জেলার সুরুজ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।’ (পৃষ্ঠা-২২৫)
উপরোক্ত দলিল-প্রমাণগুলো সামনে রাখলে আমাদেরকে একটি চরম হাস্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়! যদি ধরেই নেই যে— মৌলভী নইমুদ্দীন ১৮৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত পোস্টটির দাবি অনুযায়ী ১৮৩৬ সালে, অর্থাৎ মাত্র ৪ বছর বয়সেই মৌলবী নইমুদ্দীন পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন— এ কথাও আমাদেরকে মেনে নিতে হবে! আর যদি ১৮৩৮ সালকেই তাঁর জন্মসাল ধরা হয়, তাহলে তো বলতে হয়— যে মানুষটির অস্তিত্বই তখন ছিলো না তথাপি কেমন করে সে সময়ে তিনি কুরআনের অনুবাদ করলেন! পোস্টটির এমন উদ্ভট দাবিগুলোর উত্তরে আর কিছু না বললেও চলে, কারণ পুরো পোস্টটির ভিত্তিই মূলত— ‘১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন’— দলিল-প্রমাণবিহীন এই আজগুবি কথাটির ওপর! তবে তারপরও চেষ্টা করবো বাদবাকি দাবিগুলোর অসারতা যথাযথভাবে প্রমাণ করতে। ভুঁইফোঁড় কিংবা তথাকথিত কোনো তথ্য-সূত্র থেকে নয়, অবশ্যই নির্ভরযোগ্য তথ্য-সূত্রের সাহায্য নিয়ে।
বলে রাখা দরকার, সম্পূর্ণ পোস্টটি যেহেতু এখানে তুলে দেয়া সম্ভব নয়, তাই চেষ্টা করবো সেখান থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে। এছাড়াও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জায়গা থেকেও পোস্টটির কিছু কিছু বক্তব্য আমাদের কাছে যথেষ্ট আপত্তিজনক বলে মনে হয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের আগেও বেশ কয়েকজন মনীষী পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর কোনটিই আসলে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ছিল না। গিরিশচন্দ্র সেনই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করতে সক্ষম হন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই অনুবাদের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তা শেষ করেন। কিন্তু পোস্টটিতে দাবি করা হয়েছে— মৌলবী নইমুদ্দীন সর্বপ্রথম কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন, আর ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নাকি সেটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করে মুসলমানদের কাছে বিক্রি করেন তাঁর নিজ ধর্ম তথা ব্রাহ্মধর্মের প্রচারের জন্য অর্থের জোগান দেওয়ার উদ্দেশ্যে! কিন্তু ইতিহাস বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা! প্রকৃত সত্য হলো, মৌলবী নইমুদ্দীন কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ শেষ করে যেতে পারেননি। এর আগেই তিনি পরপারে পাড়ি জমান। এ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন—
‘নইমুদ্দীনের প্রধান কীর্তি কুরআন শরীফের বাংলা তরজমা। এই কাজে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনি পথিকৃৎ। ১৮৯২ থেকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খণ্ডে খণ্ডে নয় (৯) পারার অনুবাদ প্রকাশিত হয়, তার মৃত্যুর পর দশম পারার অনুবাদ গ্রন্থাকারে বের হয়। এরপর তিনি আর অনুবাদ করে যাননি।’ (পৃ. ২৬৮-২৬৯)
ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, নইমুদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্ররা ২৩ পারা পর্যন্ত অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল অদুদ তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’-এ লিখেছেন—‘একাদশ পারার মুদ্রণকার্য শেষ হওয়ার পূর্বেই মাওলানা নঈম উদ্দীন ইন্তিকাল করন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর পুত্রগণ মরহুমের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যে কাসেম উদ্দীন ও ফখর উদ্দীন আহমদ-ই অনুবাদকার্যে এগিয়ে আসেন। তাঁরা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও টীকা লিখনকার্য এত দ্রুতভাবে সম্পাদন করেছিলেন যে, এক বছরের মধ্যেই ১১শ পারা থেকে ২৩শ পারা পর্যন্ত অনুবাদ ও প্রকাশনা সমাপ্ত করতে সক্ষম হন।’ (পৃষ্ঠা-১৩৭)
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’-তে লিখেছেন—‘মওলানা নঈমউদ্দীন সাহেব স্বীয় জীবদ্দশায় এই আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। এমনকি তাঁর পুত্রদ্বয়ের হাতে যে অবশিষ্টাংশ অনূদিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছিল তাতেও পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি।’ (পৃষ্ঠা-৮৫)
অধ্যাপক ড. মোফখ্খার হুসেইন খান তাঁর ‘পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—‘মওলানা নঈমূদ্দীন নিজ বাসস্থান শুরুজে এন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর শেষ কথা ছিল : “আফছোছ! কোরান শরীফের তরজমা শেষ করে যেতে পারলাম না।”’ (পৃষ্ঠা-৬১)
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মৌলবী নইমুদ্দীন যেখানে কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি সেখানে তাঁর অনূদিত কুরআন প্রকাশের বিষয়টি তো অবান্তর মাত্র! এখানে অবশ্য প্রশ্ন আসতে পারে— ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের নামে অনূদিত যে কুরআনটি বর্তমানে প্রচলিত রয়েছে সেটি তাহলে কার অনুবাদ? এবার আমরা সে প্রশ্নেরই জবাব দিতে চেষ্টা করবো।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’-তে লিখেছেন— ‘ভাই গিরীশচন্দ্রের এই বাংলা তরজমার কয়েক খণ্ড প্রকাশ পাওয়ার পরই তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জনৈক মুসলিম তাঁকে কতল করার হুমকি দিয়েছিলেন। অপরাধ শুধু এই যে, বিধর্মী হয়ে তিনি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের তরজমা করেছিলেন। পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুসলমানই গিরীশ বাবুকে তাঁর এই বাংলা তরজমার জন্য অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কলকাতার আহমদুল্লাহ সাহেব এবং কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবী উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রবৃত্তিধারী জনাব আবদুল আলা ও আবদুল আযীয সাহেবান ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চে গিরীশ বাবুকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অভিনন্দন জানিয়ে ইংরেজিতে পত্র লিখেছিলেন। এই প্রশংসাপত্র সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং গিরীশচন্দ্রের অনূদিত কুরআন মজীদের প্রথম খণ্ডের শুরুতেও সংযোজিত হয়।’ (পৃ. ৫৭-৫৮)
উল্লেখ্য যে, গিরিশচন্দ্র সেনের এই অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন সময়ে তাঁকে ‘মৌলবী’ এবং ‘ভাই’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। আমরা জানি, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন। সেজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, তাঁর অনূদিত কুরআনেও ব্রাহ্মধর্মের আকিদা-বিশ্বাসের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন তাঁর অনুবাদে ‘আল্লাহ্’ শব্দকে কখনো ঈশ্বর, কখনো বা পরমেশ্বর বলে অনুবাদ করেছেন!
এ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান তাঁর পিএইচডি গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’-তে লিখেছেন— ‘গিরীশ বাবুর এই তরজমা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বেঙ্গল লাইব্রেরী ক্যাটালগার বলেন— The translator has published in this number of letters from several Moulvis certifying to the correctness of this version and describing it as more faithful than any other translation of the Koran existing in any languages.
কিন্তু এ সত্ত্বেও গিরীশ বাবুর তরজমায় ভুল-ভ্রান্তির সমাবেশ ঘটেছে। তবে তার সংখ্যা খুব যে বেশি, তা নয়। আলোচ্য তরজমায় যে ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তার দু’-একটা নমুনা নিম্নে প্রদত্ত হলো:
গিরীশ বাবু সূরা ইখলাস-এর দ্বিতীয় আয়াতে ‘সামাদ’ শব্দের অর্থ লিখেছেন ‘নিষ্কাম’ এবং সূরা ‘আলা’-এর ১৬ আয়াতে ‘তু’সিরুনা’ শব্দের তরজমা লিখেছেন ‘অধিকার করিতেছে’। অথচ প্রথমোক্ত শব্দটির প্রকৃত অর্থ হওয়া উচিত ইস্পিত সত্তা, সর্ববিষয়ে নির্ভর, অমুখাপেক্ষী এবং শেষোক্ত ‘তু’সিরুনা’ শব্দের সঠিক অনুবাদ হওয়া চাই ‘প্রাধান্য দিতেছ’, ‘পছন্দ করিতেছ’ অথবা ‘শ্রেয় মনে করিতেছ’। সূরা তাৎফীফের ২১ ও ২৮ আয়াতে ‘তুকারাবুন’ নামক শব্দটি দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। গিরীশ বাবু উভয় স্থানেই এর অর্থ লিখেছেন ‘সন্নিহিত দেবগণ’। অথচ প্রথম স্থানে এর অর্থ হবে ‘সন্নিহিত সাধুসজ্জনরা’। সূরা হুমাযা-এর সপ্তম আয়াতে টীকায় গিরীশ বাবু বলেন : এই সূরাতে নরক যে বাহিরে নয়, অন্তরে— ইহাই পরিব্যক্ত হইয়াছে। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী বাবু গিরীশচন্দ্র সেন স্বীয় অনূদিত কুরআনের এই টীকার মাধ্যমে এবং অন্যত্রও তাঁর ব্যক্তিগত অভিমতের কথা ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। কারণ ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা বাহ্যিক বেহেশত-দোযখের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।’ (পৃ. ৬৪-৬৫)
সম্মানিত পাঠক! এবার আপনারাই বলুন, এতোক্ষণ যে দলিল-প্রমাণগুলো আমরা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি তাতে করে কি একথাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না যে, এটি কোনোভাবেই একজন মুসলমান ব্যক্তির করা অনুবাদ হতে পারে না! আর প্রবল পাণ্ডিত্যের জন্য ‘আলিম-উদ-দহর’ অর্থাৎ ‘জ্ঞান-সমুদ্র’ উপাধিপ্রাপ্ত মৌলবী নইমুদ্দীনের ব্যাপারে এ ধরনের প্রলাপোক্তি করা নিঃসন্দেহে ধৃষ্টতাও বটে! অতএব, এটি যে একজন অমুসলিম ব্যক্তির তথা ভাই গিরিশচন্দ্র সেনেরই অনুবাদ এ বিষয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশই রইলো না।
পোস্টটিতে আরো দাবি করা হয়েছে যে, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নাকি আরবি জানতেন না, আরবি ব্যাকরণ জানতেন না! এটিও ভাই গিরিশচন্দ্র সেন সম্পর্কে একটি চরম অপপ্রচার ও অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। আসুন, এবার আমরা এ সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস জেনে আসি। এ বিষয়ে গিরিশচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে ৯০-৯৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তারিত তথ্যের অবতারণা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ‘আত্ম-জীবন’ বইটা পড়ে দেখতে পারেন। এ সম্পর্কে গবেষক ড. মোহাম্মদ আলী খান তাঁর ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থে লিখেছেন—‘তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। এই বয়সে নতুন করে শেখার মানসিকতা সহজে থাকে না। তথাপি গিরিশচন্দ্র সেন সেই ৪২ বছর বয়সে ১৮৭৬ সালে আরবি ভাষা শেখার জন্য লখনৌ যান। গিরিশচন্দ্র সেন সেখানে বিখ্যাত মৌলভী এহসান আলীর অধীনে আরবি ভাষা শেখা শুরু করেন। তাঁর কাছে আরবি ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজ শেখেন।’ (পৃষ্ঠা-৪৬)
এখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি কলকাতার একজন মৌলবী ও ঢাকার নলগোলার অপর একজন মৌলবীর কাছেও আরবী সাহিত্য ও আরব ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, গিরিশচন্দ্র সেন আরবি জানতেন না, আরবি ব্যাকরণ জানতেন না— আদতেই এ কথার কোনো ভিত্তি নেই!
অতএব এ আলোচনা থেকে পাওয়া গেল যে, তথ্যবিহীন, সূত্রবিহীন বিরূপ প্রচারণার যে বিষয়গুলো প্রধান, তার মধ্যে— ১. মৌলবী নইমুদ্দীনের জন্মসাল ১৮৩২ অথবা ১৮৩৮ হওয়ায় তিনি যে ১৮৩৬ সালে কুরআন অনুবাদ সম্পন্ন করতে সক্ষম ছিলেন না— তা প্রমাণিত হলো। ২. বিজ্ঞ আলেম মৌলবী নইমুদ্দীন জীবদ্দশায় পবিত্র কুরআনের মাত্র ১০ পারা অনুবাদ করে যান। বাকি অংশ অনুবাদ করতে না পারায় তিনি আফসোস করে গেছেন। ৩. মাওলানা আমীরউদ্দীন বসুনিয়াসহ আরো অনেকেই ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের আগে কুরআন অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই পুরো কুরআনের অনুবাদ করেননি। এ কারণে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরিফের অনুবাদক। ৪. গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশ পাওয়ার পর সেই সময়ে মুসলিম সমাজে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, একটি তার বিপক্ষে এবং অপরটি তার এ কাজের প্রশংসা। অধিকাংশ জ্ঞানী-গুণী মুসলিম ব্যক্তিবর্গ তখন গিরিশচন্দ্রকে সাধুবাদ জানিয়ে তাকে নিজেদের কাছে টেনে নেন। এমনকি তাকে ‘মৌলবী’ উপাধিও দেন। তার সেই ‘কোর-আন শরীফ’-এর অনেকগুলো সংস্করণ ছাপা হয়। কাজেই তার কোরআন অনুবাদের বিষয়টি ইতিহাসের অংশ এবং ব্যাপক আলোচিত। হঠাৎ করে কেউ তার নামে ‘এ কথা’ চালু করে দিয়েছেন, এমন নয়। ৫. গিরিশচন্দ্র সেন পারিবারিকভাবেই আরবি-ফারসির ঐতিহ্য বহন করতেন এবং অনুরাগী ছিলেন। তার পূর্বপুরুষগণ আরবি-ফারসির চর্চা করতেন। তিনি কুরআন-হাদীস ও ইসলামী শাস্ত্র অনুবাদের লক্ষ্যে আরবি শিক্ষা করতে সুদূর লখনৌ পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
সুবিজ্ঞ পাঠক! এতোক্ষণ আমরা নির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণ এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করে একে একে পোস্টটির প্রতিটি দাবি খণ্ডন করতে চেষ্টা করেছি। একটি ভুল প্রচারের নিরসনের নামে যারা নিজেরাই এক অর্থে ভুলের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন আশা করবো এবার তারা এই ‘ভুল’ থেকে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হবেন!
শেষ করবো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম চিন্তক, সাংবাদিকতার পথিকৃত, রাজনীতিবিদ, ইসলামীশাস্ত্রজ্ঞ ও সমাজ সংস্কারক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র— দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ‘মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র বক্তব্য দিয়ে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মৃত্যুর অনেক পরে ২৪ নভেম্বর ১৯৩৬ সালে যখন ‘নববিধান পাবলিকেশন কমিটী’র উদ্যোগে গিরিশচন্দ্রের অনূদিত কোরআনের ৪র্থ সংস্করণ বের হয় তখন সেটির ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি। মওলানা আকরম খাঁ লিখেছেন—‘তিন কোটি মোসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা, তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশের কোন মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবী-পার্শী ভাষায় সুপণ্ডিত মোসলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল, তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরু কর্তব্যভার বহন করার জন্য সুদৃঢ় সঙ্কল্প নিয়া সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন— বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে। গিরীশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
লেখকদ্বয়: কামরুল ইসলাম হুমায়ুন, কবি ও সাংবাদিক এবং মো. সাফায়েতুজ্জামান (শাফায়াত তৌসিফ), এমফিল গবেষক।
.