বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব:ভয়াবহ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব:ভয়াবহ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানল ‘হিট ডোম’ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে কোথাও কোথাও বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তুষারঝড় হচ্ছে। চীন-ভারত-নেপাল-পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যা-ভূমিধস, ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল তামিলনাড়ু–তে অস্বাভাবিক তাপদাহ। ভারতের কেরালা-মহারাষ্ট্রে প্রলয়ঙ্করী বন্যা, সৌদি আরবে আকস্মিক অতিবৃষ্টি-বন্যা ছাড়াও মরুদেশটিতে তুষারপাত হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব অস্বাভাবিক দুর্যোগের ঘটনার মধ্যদিয়ে আবহাওয়া-জলবায়ুর একের পর এক চরম বৈরী আচরণ ফুটে উঠেছে। এসব ঘটনা ভয়ঙ্কর আগামীর অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে। বিজ্ঞানীদের এইসব ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা বর্তমান অবস্থাকে ‘আবহাওয়া-জলবায়ুর অবনতিশীল সহিংস রূপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ‘চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন’- একথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা এখন স্বীকার করছেন।

মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন প্রকৃতি ও পরিবেশ। কিন্তু প্রতিনিয়ত মানুষ এ পরিবেশকে নানাভাবে দূষিত করে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছে। ঠিক খাল কেটে কুমির আনার মতো, পরিবেশের ক্ষতি করে মানুষ নিজেই তার চরম ক্ষতি করছে। বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশ দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। এর ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে বহুমুখী দুর্যোগ-দুর্ভোগ নেমে আসছে দেশে দেশে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্রমেই কঠিন, ব্যয়বহুল, অস্বাস্থ্যকর এবং দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে আবহাওয়ার ভয়াবহ বৈরিতা। এতে কোথাও অস্বাভাবিক বন্যা, কোথাও দাবদাহ আবার কোনো দেশ ভূমিকম্পে হচ্ছে বিপর্যস্ত। সামগ্রিকভাবে আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ মোকাবিলায় প্রস্তুতি-ব্যবস্থাপনা দুর্বল। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। 

বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আইনুন নিশাত বাংলা ম্যাগাজিনকে  বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের খামখেয়ালির খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উঞ্চতার ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সময়ের সাথে সাথে দুর্যোগের প্যাটার্ন বদলাচ্ছে। গত বছর তিস্তা, বহ্মপুত্র নদীর পানির উচ্চতা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। এরপর আবার তীব্র খরা দেখা যায় দেশের অন্য অঞ্চলগুলোতে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন ও প্রশমনের ওপর সমান জোর দিতে হবে। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি, ফান্ড তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে দ্বীপগুলো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পরিবেশবিদের মতে, আবহাওয়ার এই বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশও এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। প্রকৃতির বৈরী আচরণে এরই মধ্যে অতিবৃষ্টি খরা-অনাবৃষ্টি, ঢল-বন্যা, দাবানল, হিটস্ট্রোকে ফসলের জমি পুড়ে যাওয়া, বজ্রপাত-বজ্রঝড়, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধস জনস্বাস্থ্যহানি প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি ফল-ফসলে বিপর্যয় সমুদ্রসৈকতে খাদ সৃষ্টি জোয়ারের তীব্রতা কৃষিজমিতে লবণাক্ততার আগ্রাসন, নদীভাঙন এসব দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন মৃদু ভূমিকম্পও বড় ভূমিকম্পের ইশারা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক শেখ আনোয়ার বলেন, আবহাওয়ার এই বিপর্যয়ের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন দারুণভাবে বিপর্যস্ত। এটি প্রকৃতির জন্যও ভীষণ হুমকিস্বরূপ। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট ঝুঁকিগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে ভূমিক্ষয়, ভূমিকম্প, পানি এবং ভূমির লবণাক্ততা, দূষণ এবং আর্সেনিক দূষণ নিয়ে আসছে। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন তীব্র হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে গলে যাচ্ছে পর্বত শিখরের বরফ আর মেরু অঞ্চলের হিমবাহ। ফলে সমুদ্রের পানির স্তর আরও উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। সমুদ্রের নোনা পানি প্লাবিত করছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সব মিলিয়ে দেশ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

বাংলাদেশেও ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতি মাস, বছরের গড় তাপমাত্রার হিসাবে। যেমনঃগত জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) মাসে সারা দেশে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে শূন্য দশমিক তিন এবং শূন্য দশমিক এক ডিগ্রি সে. বেশি ছিল। এর আগের মাস, বছরজুড়ে পারদ ছিল ঊর্ধ্বে। এর ফলে বেড়ে গেছে বৃষ্টিপাত। আবার বৃষ্টিপাতেও ব্যাপক অসঙ্গতি হচ্ছে। অন্যদিকে মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চল।

আবহাওয়া-জলবায়ুর আবহমানকালের চিরচেনা রূপ ও বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। চিরায়ত ষড়ঋতুর আদি চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্জিকার ছকে ‘বর্ষা’য় বৃষ্টি ঝরে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অকালে’ অঝোর বর্ষণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ঘন ঘন প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারে ও অতিবর্ষণে ভাসছে। ছোট ছোট  জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বাড়ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য থাকায় গ্রীষ্মের খরতাপ যেন মরুর আগুনের হলকা। অসহনীয় ‘গরমকাল’ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু ‘শীতকাল’র স্থায়িত্ব অল্প কিছুদিন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পঞ্জিকার পাতায় থাকলেও আলাদা করে চেনা যায় না, জনজীবনে তেমন অনুভূতি জাগায় না। এককালে মানুষের বান্ধব যে আবহাওয়া-জলবায়ু, তা এখন জটিল সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ধকলে হ্রাস পাচ্ছে মানবসম্পদের উৎপাদনশীলতা।

বাংলাদেশ শুধুই নয়। মারাত্মক বৈরীরূপ ধারণ করা আবহাওয়া-জলবায়ুর কবলে দেশে দেশে দুর্যোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার অনেক দেশে খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডোর মতো বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়া হলে চরম আবহাওয়ার কবলে পড়বে পৃথিবী। যা এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। তবে জার্মানির ভয়াবহ বন্যা, উত্তর আমেরিকার হিট ডোম, যা স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানলসহ  বিশ্বের দেশে দেশে ঘটমান নজিরবিহীন ও চরম দুর্যোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। তবে তারা কয়েক দশক যাবৎ সতর্ক করে আসছেন দ্রুতগতিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং আরও মারাত্মক ধরনের দাবানল ও তাবদাহের সৃষ্টি হবে।

Exit mobile version