ওসি রফিক প্রশ্ন করেন, হিন্দুরা জান্নাতে যাবে না- এ কথা তোদের কে বলেছে?

পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহ রূপ দেখেছেন হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক ছাত্র মাওলানা আসাদুল্লাহ। মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য গ্রেপ্তারের পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় নির্যাতন। রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় বর্বর শারীরিক নিপীড়ন। হ্যান্ডকাফ আর পায়ে বেড়ি পরিয়ে বেদম মারধরে যখন নাক-মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল, তখনো তার ওপর নতুন করে শুরু হয় পিটুনি। প্লাস দিয়ে তার নখ তুলে ফেলে সেখানে সুঁই ঢোকানো হয়। কারেন্টের শক দেওয়া হয় পায়ে। ১৩টি মামলায় কয়েক দফায় ১১ দিন রিমান্ড ছাড়াও ১৬ মাস কারাজীবনও ছিল অনেক কষ্টকর।

হাটহাজারী থানার সাবেক ওসি রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চলে এসব নির্যাতন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ হাটহাজারী উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন ইস্যুতে ওই এলাকায় সোচ্চার থাকায় তরুণ আলেম মাওলানা আসাদুল্লাহর ওপর নির্যাতনের মাত্রাটা বেশি ছিল বলে মনে করেন তিনি। শুধু নিজের ওপর নয়, তার দুই ভাইকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটপাটের পাশাপাশি বাকি দুই ভাইকেও বাড়িছাড়া করা হয়। সন্তানদের ওপর এই অত্যাচারে বৃদ্ধ বাবা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে আছেন। এখনো শয্যাশায়ী তার মা। সার্বিকভাবে অনেকটা নিঃস্ব ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তার পরিবার।

মাওলানা আসাদুল্লাহ বলেন, হেফাজতে ইসলাম এবং সংগঠনটির মরহুম আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর গতিকে থামিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী সরকারের। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ একটি মিছিলে সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে গুলি চালিয়ে হাটহাজারী মাদরাসার চার ছাত্রকে শহীদ করে পুলিশ। সরকারদলীয় লোকরা ব্যাপক তাণ্ডবও চালান। তারা থানা ভাঙচুর, ডাকবাংলো ও ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় জ্বালাও-পোড়াও করেন। এ ঘটনায় হেফাজতকে টার্গেট করে তারা অন্তত ১৩টি মামলা করেন।

এরপর থেকেই গ্রেপ্তার শুরু করে পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকের সঙ্গে হাটহাজারী মাদরাসায় আশ্রয় নেন মাওলানা আসাদুল্লাহ। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালায় পুলিশ। তারা জানতে পারে, মাওলানা আসাদুল্লাহসহ তার ঘনিষ্ঠজনরা জুনায়েদ বাবুনগরীদের সাহস জুগিয়ে আসছেন। এ জন্য তার ওপর রোষটা একটু বেশি ছিল।

মাওলানা আসাদুল্লাহ বলেন, আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মঈনুদ্দিন রুহী ও আবু রেজা নদভী গ্রুপ যখন হেফাজতে ইসলাম এবং কওমি অঙ্গনকে আওয়ামী সরকারের দালাল বানানোর তৎপরতা চালাচ্ছিলেন, তার বিরুদ্ধে হাটহাজারীতে সোচ্চার ছিলাম আমরা। এ জন্য আমার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল তারা। তিনি বলেন, প্রথমে আমাকে না পেয়ে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার, বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর এমনকি পরিবারের নারীদেরও মারধর করে পুলিশ। আমার মেজো ভাইকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারে হাটহাজারী থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার রাজিব শর্মা ও এসআই মুকিব আল হাসান। তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রথমে আমার দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পরে থানায় নিয়ে গিয়ে তার ওপর ব্যাপক অত্যাচার এবং প্লাস দিয়ে টেনে টেনে হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। পরে চারটি মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, এর আগের দিন তার ছোট ভাই আমিনুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হয়। তার হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। একে একে ১৪টি মামলা দিয়ে তাকে দুবছর জেলের কনডেম সেলে রাখা হয়।

হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক এই ছাত্র বলেন, এর আগেও ২০২০ সালের দিকে ডিজিএফআই, এনএসআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। দিনের পর দিন তাদের অফিসে নিয়ে বসিয়ে রাখা হতো। হুমকি-ধমকিসহ বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করা হতো।

গ্রেপ্তার এড়াতে দীর্ঘদিন মাদরাসায় অবরুদ্ধ থাকার পর ২০২১ সালে কোরবানির ঈদের দিন কিছুটা নিরাপদ মনে করে পরিবারের সদস্য ও চার মাসের শিশুসন্তানকে দেখতে বাড়িতে যান মাওলানা আসাদুল্লাহ। ঈদের নামাজ পড়ে সকাল ৯টার দিকে বাড়িতে পৌঁছাতেই সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যরা ওই এলাকা ঘিরে ফেলেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে হ্যান্ডকাফ ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে র‌্যাব-৭-এর অফিসে নেওয়া হয় তাকে। পথে তার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ ও গালাগাল করা হয়। র‌্যাব অফিসে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে অনেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিকালের দিকে হেফাজতসংশ্লিষ্ট মিথ্যা চারটি মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে মামলা বেড়ে ১৩টিতে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, আমাকে নির্যাতন করাতে ওসি রফিককে টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছে আনাস মাদানী গ্রুপের পক্ষ থেকে।

কারাগারে থাকার এক মাসের মাথায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। সেই রিমান্ডে নিয়ে আসাদুল্লাহকে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। তাকে রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি কেউ যাতে জানতে না পারেন, সেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন ওসি রফিক। রাত আড়াইটার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। তিনি বলেন, ওসি রফিকের রুমে গিয়ে দেখি সেখানে আরো কয়েকজন অফিসার বসে আছেন। তাকে হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে বেড়ির মতো কিছু পরানো হয়। চোখ ছিল বাঁধা। একটি চেয়ারে বসিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয়। সেখানে দেখতে পান যে লোহার রড, স্ট্যাম্প, ক্রিকেট ব্যাট, প্লাস, রশি ও কারেন্টের শক দেওয়ার মতো কিছু যন্ত্র রয়েছে।

প্রথমে ওসি রফিক প্রশ্ন করেন, হিন্দুরা জান্নাতে যাবে না- এ কথা তোদের কে বলেছে? উত্তরে সন্তুষ্ট না হওয়ায় চারদিক থেকে তাকে বেদম মারধর করা হয়। স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে হাঁটুতে জোরে জোরে বাড়ি দেন তারা। পেছন দিক থেকে হ্যান্ডকাফ বাধা অবস্থায় তাতে রডের চাপ দিয়ে হাড় ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা করে। লাথি, কিল-ঘুসি আর অকথ্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই। এ সময় শীর্ষ আলেমদের নামেও গালাগাল করা হয়।

রিমান্ডে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করা হয় যে, জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৭১ সালে হালদা সেতুর কাছে দু-তিন শ মানুষ মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছেন। ৭১ সালে তার জন্মও হয়নিÑ এমন কথা বললে নতুন বিষয়ে বলা হয়, বাবুনগরী পাকিস্তান থেকে ৪০০ কোটি টাকা খেয়ে তোদের জঙ্গি কার্যক্রমে রাজপথে নামিয়েছেন। হাটহাজারীর সব ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয়। এসব জিজ্ঞাসাবাদের সময় মারধর করে পুলিশ। একপর্যায়ে প্রচণ্ড পিপাসায় পানি চাইলে মুখে পেশাব করে দেওয়ার কথা বলেন। পায়ে কারেন্টের শক দিয়ে এমন অবস্থা করেন যে, মনে হচ্ছিল পা জ্বলে যাবে।

তিনি জানান, রিমান্ড চলাকালে তাকে খেতে দেওয়া হতো ছোট একটি বনরুটি আর এক বোতল পানি। তাকে অজুর পানি দেওয়া হতো না, নামাজ পড়তে দিতেন না। শুধু গালাগাল করতেন, দাড়ি-টুপি নিয়ে অকথ্য ভাষায় কথা বলতেন। ভারতের বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন করি, সে বিষয়েও তারা জিজ্ঞাসা করতেন। এ সময় পরিচিত কয়েকজন পুলিশ তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করলে তা বুঝতে পেরে তাদের বদলির হুমকি দেন ওসি রফিক।

পুলিশকেও গালাগাল করতেন তিনি অনেক চেষ্টা করেও আমার কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেননি তারা।

রিমান্ডে নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিলেন, নাক-মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল, সে অবস্থায় তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়েই সেলে নিয়ে যান। সেখানে এক পুলিশ তার মরণাপন্ন অবস্থার কথা বললে ওসি রফিক সেই অবস্থায় আবার পেটানো শুরু করেন। বে-ইজ্জতি করতে পাশের একজন হত্যা মামলার আসামির পা টিপতে বলা হয়। একপর্যায়ে তাকে আবার রিমান্ডের রুমে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চাপ দেন। তাতে রাজি না হওয়ায় কয়েকজন মিলে ধরে প্লাস দিয়ে টেনে হাতের নখ তুলে ফেলেন। সেই নখের স্থানে সুঁই ঢুকিয়ে দেন।

এ সময় জান বাঁচাতে তিন পৃষ্ঠার একটি স্বীকারোক্তি মুখস্থ করার পরামর্শ দেন এক পুলিশ। নইলে তারা মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দেন। তবে তার একটাই কথা, জীবন গেলেও মিথ্যা স্বীকারোক্তি তিনি দেবেন না। রিমান্ডে নির্যাতনে তার স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন তিনি।

রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হলে সেখানেও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। হেফাজতের কোনো নেতা নামাজ পড়াতে, ধর্মীয় কথাবার্তা বলতে পারবেন না। কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ফোনকল ছিল নিষিদ্ধ। সেখানে হেফাজতের লোকদের কোনো চিকিৎসাও দিতেন না। আসাদুল্লাহ বলেন, রিমান্ডে নখ তুলে ফেলায় রক্ত বের হচ্ছিল, হাঁটু ফুলে গেছে, হাঁটতে পারতাম না, নামাজ পড়তে পারতাম না, তারপরও কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হতো না। কারাগারে রুহুল ও এমদাদ নামের দুই নিরাপত্তারক্ষী অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন। আমার ভাইকে এক দিন মুমূর্ষু অবস্থা মেডিকেলে নিয়ে গেলেও সেখানে আড়াই ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। পরিবারের খবর নিতে এক দিন ফোন করতে গেলে গোয়েন্দারা আমাকে ধরে প্রচণ্ড মারধর করেন, চোখে ঘুসি মারেন। অনেক দিন ঠিকমতো চোখে দেখতে পাইনি।

মাদরাসাছাত্রদের হত্যার হুমকি দিতেন ওসি রফিক। তিনি বলতেন, হাটহাজারীর ছাত্রদের ধ্বংস করতেই তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে।

আসাদুল্লাহ বলেন, হাটহাজারীতে হত্যা মামলায় শুধু ওসি রফিকই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিদের কেউ লুকিয়ে, কেউ বহাল তবিয়তে আছেন। কয়েকজনকে মামলা থেকে বাদ দিয়েছে পুলিশ। তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন ওলামায়ে কেরামের। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button