নতুন মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হলেন ১৪ জন। আগে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এমন পাঁচজন এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন।
বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩০ জন নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। এর মধ্যে ৭ জানুয়ারির ভোটের আগেই বাদ পড়েন দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী। তিনজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। আর তিনজন এবার দলীয় মনোনয়নই পাননি। অবশ্য বাদ পড়া টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের একজন নতুন মন্ত্রিসভায় ফিরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য ৩৭ জন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। একই সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলা গণ্য হবে।
এরপর গতকাল রাতে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রীর নামের তালিকা পড়ে শোনান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নতুন মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীদের শপথ নিতে টেলিফোন করে জানানো হয়। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেবে। শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম জানা গেলেও কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন, তা গতকাল রাত পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি। শপথের পরে তাঁদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
আগের মন্ত্রিসভায় তিনজন উপমন্ত্রী ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভায় কোনো উপমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়নি। তবে পরে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী আরও যুক্ত হতে পারেন বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমান মন্ত্রিসভায় দুজনকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করা হয়েছে। একজন চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন, তিনি বার্ন ইউনিটের মাধ্যমে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে বেশ আলোচিত। অপরজন ইয়াফেস ওসমান, তিনি বিদায়ী মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের সময় আগুনে পোড়া মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সামন্ত লালের প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল। এ জন্য তাঁকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনে দলের মনোনয়নে ৭১ জন বাদ পড়েন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণের চেয়ে নতুনদের জায়গা দেওয়ার জন্যই বেশি বাদ পড়েছেন। এবার মন্ত্রিসভায় দলের সক্রিয় নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকের বাদ পড়া হয়তো যৌক্তিক। আবার কারও কারও বাদ পড়ার পেছনে কী কারণ তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ পুনরায় স্থান পেয়েছেন। কিন্তু কেন পেয়েছেন, এর কারণও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
অর্থ ও পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্রে
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, এবার মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের কথা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী সরকারকে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। এগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন।
এই বিবেচনায় অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুরোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বাদ পড়েছেন। এর মাধ্যমে এই দুই খাতে নতুন চিন্তা যুক্ত করা এবং নতুন করে শুরু করার একটা চেষ্টা থাকতে পারে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে ফিরিয়ে আনার ফলে তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। অর্থমন্ত্রী কে হবেন—এটা বড় প্রশ্ন। তবে আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত পাঁচ বছর অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে তাঁকে বিবেচনা করা হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
রাজনীতিতে সক্রিয় ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন
জাহাঙ্গীর কবির নানক ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর বাদ পড়েন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি দলীয় মনোনয়নই পাননি। এবার তাঁকে দলের মনোনয়নের পর পূর্ণ মন্ত্রী করা হলো। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, নানক এবার মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন আন্দোলন–কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকা এবং দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে।
ফারুক খান ২০১৯ সালে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর এবার ফিরে আসার কথা আগেই শোনা যাচ্ছিল বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুর রহমান আগে একাধিকবার সংসদ সদস্য হলেও মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে দলের মনোনয়নও হারান। এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকে কারণ হিসেবে দেখছেন তাঁর সমর্থকেরা।
এর বাইরে সাবের হোসেন চৌধুরী ১৯৯৬ সালে উপমন্ত্রী হলেও আর সরকারের দায়িত্ব পাননি। কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি নির্বাচিত হওয়া, এরপর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভূমিকা রেখে একটা অবস্থান তৈরি করেন। এ জন্য ভোটের আগে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত করা হয়। সাবের হোসেন চৌধুরীর আন্তর্জাতিক পরিচিতি কাজে লাগাতে তাঁকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে বলে দলের নেতারা মনে করেন।
সাবেক আমলা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রশাসনে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনিও তিনবারের সংসদ সদস্য। তাঁর আত্মীয় কামরুল ইসলাম একাধিকবার মন্ত্রিসভায় ছিলেন। যে কারণে মোকতাদির চৌধুরীকে এর আগে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলে মনে করা হয়।
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, আবদুস সালাম ও জিল্লুল হাকিমকে এবার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নাজমুল হাসানকে ক্রিকেট বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই বিবেচনায় তাঁকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়েছে বলে আলোচনা আছে। এ ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভি রহমানের ছেলে হিসেবে এমনিতেই তাঁর প্রতি সরকারের শীর্ষ মহলের সুদৃষ্টি রয়েছে।
উপমন্ত্রী থেকে মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং প্রতিমন্ত্রী থেকে ফরহাদ হোসেনের পূর্ণ মন্ত্রী হওয়াকে চমক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের মধ্যে দক্ষতার ছাপ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নতুন মুখ মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আহসানুল ইসলাম ও রুমানা আলী। তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্য হিসেবে একমাত্র সিমিন হোসেন রিমি জায়গা পেয়েছেন। নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে আরও রয়েছেন মো. আব্দুস শহীদ, মহিববুর রহমান, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, শফিকুর রহমান চৌধুরী।
নতুন মন্ত্রিসভায় নেই যাঁরা
আগে ছিলেন, নতুন মন্ত্রিসভায় নেই, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রমুখ। অসুস্থতার কারণে মুস্তফা কামাল বাদ পড়তে পারেন, এমন আলোচনা আগেও ছিল। তবে নতুন মন্ত্রিসভায় আব্দুর রাজ্জাকের নাম না থাকার ঘটনাকে বিস্ময়কর বলছেন দলের অনেকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে নানা সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে জাহিদ মালেককে নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল।
নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া অন্যরা হলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চোধুরী, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বাদ পড়েছেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা। দুজন উপমন্ত্রীও বাদ পড়েছেন। তাঁরা হলেন হাবিবুন নাহার ও এ কে এম এনামুল হক শামীম।