অর্থ ও বাণিজ্যবাংলাদেশব্যাংকিং

দেশে দরিদ্র মানুষের সাথে সাথে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে

দেশে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। মহামারি করোনার অভিঘাতে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আয় কমলেও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। ফলে এ সময় আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে আয় বৈষম্য ।

একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, করোনায় নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। যদিও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কী পরিমাণ মানুষ দরিদ্র হয়েছে, সেই বিষয়ে কোনো জরিপ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সেই সংখ্যাটাও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭টি। এর ৩ মাস আগে গত মার্চ শেষে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭। সে হিসাবে তিন মাসে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারী বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬০টি বা ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

জরিপ অনুযায়ী করোনায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ফলে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।

ফলে দেশেও চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ। এতে অধিকাংশ মানুষের আয় কমলেও এক শ্রেণির মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকার পাহাড় জমছে। এতে দেশের আয় বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নতুন বিনিয়োগ খুব বেশি হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের এসব অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা হচ্ছে। এ ছাড়া, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখা হতে পারে।

এতে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে, দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও দরিদ্র সীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে আয় বৈষম্য বাড়ছে।

দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকা অর্জন, হন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও দেশের আয় বৈষম্যের অন্যতম কারণ।

এসব কারণে এক শ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর সরকারকে আরো বেশি গুরত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, এবারের বাজেটেও বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মূলত দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই আয় বৈষম্য বাড়ছে। এ জন্য সরকারকে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আর তা না হলে দেশে আয়-বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব, বিষয়টি এমন নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭১ হাজারের বেশি। যার মধ্যে কোটিপতিদের টাকার পরিমাণ রয়েছে ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। যদিও মার্চ শেষে এসব অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৫ কোটি। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে জমার পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, মোট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তুলনায় কোটিপতিদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১ শতাংশও নয়। কিন্তু এসব অ্যাকাউন্টে মোট আমনতের প্রায় ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ টাকা জমা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বর্তমানে রয়েছে ৮৫ হাজার ৮৪৮টি।

এসব হিসাবে মোট টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা মোট আমানতের ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া, ৫০ কোটি থেকে উপরের হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ১৮০৫টি। যাতে টাকা রয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি। এটি মোট আমানতের ১৫ দশমিক ০৫ শতাংশ।

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে

একটি মন্তব্য

Back to top button