অপরাধএক্সক্লুসিভঢাকাবরিশালবাংলাদেশভোলা

প্রতারক জ্বীনের বাদশা জাকিরের করুণ পরিনতি

বোরহান উদ্দিন থানার পূর্ব-মহিষখালী গ্রামের বাসিন্দা জাকির হোসেন ওরফে বাচ্চু (৩৮)। তিনি সিদ্দিক ফরাজীর ছেলে। পেশায় একজন প্রতারক। জিনের বাদশার পরিচয় দিয়ে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতারণা করে টাকা আয় করতেন।

প্রথম স্ত্রী সুরমা আক্তারকে ডিভোর্স দিয়ে দুই বছর আগে আরজু আক্তার নামের আরেক নারীকে বিয়ে করেন। ভালোবেসে বিয়ে করলেও জাকির আরও একাধিক নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে  তোলেন। ঘরে স্ত্রী রেখেও অন্য নারীর সঙ্গে রাত কাটাতেন।

প্রতারণা করে যা আয় হতো তার পুরোটাই ওই নারীর পেছনে ব্যয় করতেন। জাকিরের একাধিক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক মেনে নিতে পারতেন না স্ত্রী আরজু। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি ও মনোমালিন্য হতো।

জাকির হোসেন বাচ্চু দুই বছর আগে জিনের বাদশা পরিচয়ে আরজু আক্তারকে ফোন দেন। তারপর থেকে আরজু আক্তারের সঙ্গে জাকিরের পরিচয়, প্রেম ও পরে তারা বিয়ে করেন। জাকির তার স্ত্রী আরজুকে জিনের বাদশা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে এবং তাকেও এই কাজে পারদর্শী করেন।

আরজুর সঙ্গে বিয়ের পরও জাকির একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। জিনের বাদশার পরিচয়ে প্রতারণার মাধ্যমে জাকির যে অর্থ উপার্জন করতেন তা অনৈতিক কাজে খরচ করতেন। ৫ মাস আগে আরজুকে তালাক দেন জাকির।

তালাক দেয়ার পরও জাকির আরজুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। শারীরিক সম্পর্ক থাকাকালে জাকিরের  একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি আরজুর কাছে আবার ধরা পড়ে। এতে আরজু আরও বেশি ক্ষিপ্ত হন এবং জাকিরকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। 

ক্ষোভ থেকে আরজু এক সময় জাকিরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গত ২৯শে জুলাই ঢাকা থেকে লঞ্চের কেবিনে করে ভোলা যাওয়ার পথে আরজু সুযোগটা কাজে লাগান। দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অজ্ঞান করে শ্বাসরোধ করে স্বামীকে হত্যা করে পালিয়ে যান।

স্বামীকে হত্যা করে পালিয়ে গেলেও রেহাই পাননি আরজু। হত্যা করে কেবিনের খাটের নিচে মরদেহ লুকিয়ে রাখেন। পরে ওই লঞ্চটি আবার ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। একই কেবিনে ওঠা অন্যান্য যাত্রীরা মরদেহ দেখতে পেয়ে খবর দেন পুলিশে।

পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। নিহতের প্রথম স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার তদন্ত পেয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রহস্য উদ্‌ঘাটন করে। একই সঙ্গে ঘাতক আরজু আক্তারকে গ্রেপ্তার করে। আরজু হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল পিবিআই’র পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়।

পিবিআই জানায়, চলতি বছরের ২৯ জুলাই সকাল ৭টার দিকে সুরমার স্বামী বাড়িতে আসবে বলে জানান। পরে একাধিক ফোন দিলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। যথাসময়ে বাচ্চু বাড়িতে না যাওয়ায় সুরমার সন্দেহ হয়। বিষয়টি তিনি স্বজনদের জানান।

পরে সদরঘাট নৌথানার মাধ্যমে খবর পান, বাচ্চুর লাশ পাওয়া গেছে। লঞ্চের কর্মচারীদের মাধ্যমে সুরমা জানতে পারেন, কেবিনে তার স্বামীর সঙ্গে কফি রংয়ের বোরকা পরা মুখ ঢাকা অবস্থায় একটি মেয়ে ছিল। বাচ্চুর মৃত্যুর পর তাকে আর দেখা যায়নি।

পিবিআই জানায়, ঘটনার আগের দিন জাকির হোসেন বাচ্চু তার এক পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে রাত্রী যাপন করেন। বিষয়টি আরজু বুঝতে পারেন। জাকির ঘটনার দিন ২৯শে জুলাই ঢাকা থেকে লঞ্চে গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

বিষয়টি আরজু জানতে পারেন। তখন আরজু জাকিরকে লঞ্চের কেবিন ভাড়া করে তাকেও বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। দু’জনের বাড়ি একই এলাকায় হওয়াতে জাকির ঢাকা থেকে ভোলাগামী এমভি গ্রীন লাইন-৩ লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করেন। ভাড়া নেওয়ার সময় তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লঞ্চে ওঠেন।

লঞ্চে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত আরজু বোরকা পরা ছিল। এতে করে তার মুখ কেউ দেখতে পায়নি।  পিবিআই জানায়, সকাল ৮টার দিকে তারা সদরঘাট থেকে ভোলায়  যাওয়ার জন্য লঞ্চে ওঠেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আরজু দুধের সঙ্গে ৫টি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে লঞ্চে ওঠেন। জাকিরও রসমালাই কিনে লঞ্চে ওঠেন।

লঞ্চের কেবিনে তারা শারীরিক মেলামেশা করেন। ঘন্টাখানেক পর আরজু ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ জাকিরকে খাইয়ে দেন। দুধ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে জাকির অচেতন হয়ে গেলে ওড়না দিয়ে তার হাত এবং পা বেঁধে ফেলেন আরজু। পরে অন্য একটি ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।

হত্যার পর জাকিরের  মরদেহ কেবিনের স্টিলের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। লঞ্চটি ভোলার ইলিশা ঘাটে পৌঁছালে আরজু আক্তার নেমে যান। ওইদিন দুপুর আড়াইটায় লঞ্চটি ইলিশা ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশের চৌকস একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। পরে ৩১শে জুলাই নিহত জাকিরের প্রথম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করে। মামলাটি পিবিআই’র  সিডিউলভুক্ত হওয়ায় ১লা আগস্ট পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্যোগে মামলাটির তদন্ত অধিগ্রহণ করে।

মামলাটি অধিগ্রহণ করার ৪৮ ঘণ্টার আগেই আসামি আরজু আক্তারকে সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। আসামি মঙ্গলবার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

এর আগে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ওই কেবিনটি তিন শিশুসহ দুইজন নারীকে ভাড়া দেন। লঞ্চটি ঘাট ছেড়ে আসার প্রায় দুই ঘণ্টা পর নারীদের সঙ্গে থাকা একটি শিশু খাটের নিচে প্রবেশ করলে একজন নারী খাটের নিচ থেকে শিশুকে আনতে গেলে মরদেহ দেখে চিৎকার শুরু করেন। বিষয়টি লঞ্চের স্টাফদের নজরে আসে।

লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সদরঘাট এসে বিষয়টি ঢাকা সদরঘাট নৌ থানা পুলিশকে অবহিত করেন। সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের জন্য পিবিআইকে অবহিত করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের ক্রাইমসিন টিম নিহত জাকির হোসেন বাচ্চুর পরিচয় শনাক্তের পর বিষয়টি পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশকে অবহিত করেন। 

Back to top button