অপরাধআওয়ামী লীগএক্সক্লুসিভঢাকাবাংলাদেশরাজনীতিরাজবাড়ী

চাকরী ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে পাল্টে গেলো তাঁর কপাল

নজরুল ইসলাম মণ্ডল। গোয়ালন্দ পৌরসভার মেয়র। ২০০৩ সালে চাকরি শুরু করেন পায়াক্ট নামের একটি এনজিওতে। শুরুতে ছিলেন পিআর অর্গানাইজার। বেতন এক হাজার। ২০০৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। একপর্যায়ে ছেড়ে দেন চাকরি। রাতারাতি পাল্টে যায় তার কপাল।

গোয়ালন্দে নজরুলের রয়েছে নিজস্ব বলয়। তাদের দিয়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের পরিবহন সেক্টরকে চাঁদাবাজির আখড়া বানিয়ে রেখেছেন। ঘাটের মূল নিয়ন্ত্রণ করেন মোস্তফা মণ্ডল। তিনি নজরুল মণ্ডলের ভাই। পারাপারের উদ্দেশে ঘাটে আসা পরিবহনের চালকরা নিজের হাতে ফেরির টিকিট কাটতে পারেন না। নজরুলের লোকজন টিকিট কেটে দেয়।

এ কারণে টিকিটের নির্দিষ্ট মূল্য থেকে বেশি টাকা গুনতে হয় গাড়ি চালকদের। প্রতিদিন এ ঘাট থেকেই লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে আয় করে এই চক্র। এ টাকার ভাগ পায় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও বিআইডব্লিউটিএ’র কয়েক কর্মকর্তা। এভাবে নজরুল মণ্ডলের বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সব পরিবহন।

একে একে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নুরু মণ্ডলের হাত ধরেই নজরুলের উত্থান। দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। নুরু মণ্ডল তেমন পড়াশোনা জানতেন না। তার অবর্তমানে যেকোন কর্মসূচিতে কথা বলতেন নজরুল মণ্ডল। নুরু মণ্ডল মারা যাওয়ার পর এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন নজরুল মণ্ডল।

বর্তমানে পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে থাকা নজরুলের এক সময় ছিল ভাঙা ঘর। জরাজীর্ণ পৈতৃক বাড়ি নদীতে ভেঙে গেলে গোয়ালন্দ শহরে প্রধান সড়কের পাশে নতুন জায়গা কিনে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। চলাচল করেন বুলেটপ্রুফ গাড়িতে।

নজরুলের বর্তমান বাড়িটির মূল্য কয়েক কোটি টাকা। তার স্ত্রীর চলাচলের জন্য ব্যবহৃত গাড়িটির দামও কোটি টাকা। রাজবাড়ীতে নজরুলের রয়েছে ১৫০ বিঘার মতো জমি। এছাড়া ৫০ বিঘার উপর রয়েছে বালুর চাতাল। মেয়র হওয়ার পর থেকে পৌরসভার সকল টেণ্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন নজরুল।

এখান থেকে কেউ কোনো কাজ নিতে হলে তাকে দিতে হয় ১৬ পারসেন্ট কমিশন। এছাড়া চাকরি দেয়ার নাম করে এবং পৌরসভার বিভিন্ন কাজের জন্য জমি ক্রয় করার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

জানা যায়, মৌসুমে প্রতিটি ফলের গাড়ি থেকে নেয়া হয় ২০০০ টাকা। প্রতিদিন ৪০০ গাড়ি আসে ঘাটে। বর্তমানে কিছুটা কম। গরুবাহী গাড়ি থেকে নেয়া হয় ৫৫০-৬০০ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০টি গরুবাহী ট্রাক ঘাটে আসে। গাড়ি কমে গেলে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়। বেশি হলে আবার আগের রেট নেয়া হয়। মাছের গাড়ি থেকে প্রতিদিন নেয়া হয় ২৫০০ টাকা। প্রতিদিন গাড়ি ঢোকে প্রায় ৩০০ এর মতো।

২০১৪ সালে টেন্ডার নিয়ে বিরোধের জেরে গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সামনে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন। অভিযোগ- নজরুলের মদতে খুন হন জাহাঙ্গীর। খুনিদের পালিয়ে যেতে তিনি সহায়তা করেন। এ বিষয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নজরুলের সম্পর্কে এলাকার প্রায় সবাই জানে। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

এছাড়া দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথের নাব্যতা ঠিক রাখতে প্রায় সারা বছর বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং কার্যক্রমের তেল লোপাট করে নজরুলের লোকজন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চলাচলকারী ফেরির তেল চুরিও তার নিয়ন্ত্রণে হয়।

এছাড়া ২০১৯ সালের অক্টোবরে উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রেজাউল মোল্লা ওরফে আবু ডাক্তার নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন নজরুল মণ্ডল। এ সময় উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বহিষ্কারও হন তিনি।

তোফাজ্জল হোসেন তপু। এলাকায় পরিচিত কালুখাঁ নামে। শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি নজরুল মণ্ডলের লোক। এক সময় প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা নুরু মণ্ডলের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। নিয়ন্ত্রণ করেন জুয়ার আখড়া। এই আখড়াগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা জুয়া খেলা হয়।

এতে যারাই জয়লাভ করেন তাদের প্রতি হাজারে কালুখাঁর নামে ৪০০ টাকা দিতে হয়। পতিতালয়ে রয়েছে তার পাঁচটি বাড়ি। যৌন পল্লীতে খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়ার আসরসহ মাদক বিক্রি ও সেবন নিয়ন্ত্রণ করে তপু। এ সুবাদে পল্লীর ভেতরে দুই জায়গায় যত্রতত্র খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়া জমজমাট চলে রাত-বিরাত।

এই জুয়ার টাকা রাতের বেলা বস্তা ভরে পল্লী থেকে নিয়ে যায় তার লোকজন। এর থেকে মোটা অংকের ভাগ পায় নজরুল মণ্ডল। দৌলতদিয়ায় তপুর রয়েছে আলিশান বাড়ি। এখানে কোনো ঝামেলা হলে এর বিচার সালিশ করেন তপু। তার রয়েছে ১০টি ড্রাম্প ট্রাক ও ১০টি ভেকু। এছাড়া স্থানীয় খানকা শরীফের পাশে ১০ বিঘা জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

দৌলতদিয়া পল্লী নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে নজরুলের বলয়ের লোকজনের বিরুদ্ধে। জানা যায়, পল্লীতে আসা সাধারণ মানুষকে অস্ত্র ধরে সর্বস্ব কেড়ে নেয় তারা। এ ধরনের বহু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত নজরুল মণ্ডলের লোকজন।

নজরুল মণ্ডলের এ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ’র কোনো কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো সেক্টরের কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে হেনস্তা অথবা বদলি করিয়ে দেয়ার কথা চাউর রয়েছে।

এদিকে সরকারি নিয়মনীতি না থাকলেও দেশের সর্ববৃহৎ এই পল্লীতে প্রবেশে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করে নজরুলের লোকজন। এ পল্লীতে অন্তত ৪ হাজার যৌনকর্মীর বসবাস। এখানে ঢুকতে হলে নজরুলের নিজস্ব পাহারাদার বাহিনীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়।

প্রবেশ পথে প্রতিদিন ২-৩ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে। এই পাহারাদার বাহিনী অনেকে আবার ভেতরে ঘুরে ঘুরেও টাকা তোলে। পল্লীর ভেতর থেকে কেউ বাইরে এলে তাকে আবারো টিকিট নিয়ে পল্লীতে প্রবেশ করতে হয়।

নজরুল মণ্ডল উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বহিষ্কারের পর জেলে থাকা অবস্থায় শুরু হয় গোয়ালন্দ পৌর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। তাকে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি করার জন্য নাম প্রস্তাব করা হয় জেলা আওয়ামী লীগ থেকে। কিন্তু যুবলীগ থেকে বহিষ্কারের কারণে তখন সেটা আর করা যায়নি।

এর পরিবর্তে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা নজরুল মণ্ডলের স্ত্রী কাকলী নজরুলকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। যদিও এই পদ পাওয়ার আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না কাকলী মণ্ডলের।

স্ত্রী সভাপতি হওয়ার পর ওই হত্যা মামলায় জেল থেকে জামিনে বের হন নজরুল মণ্ডল। পরে পৌর আওয়ামী লীগের ১নং সহ-সভাপতি পদে বসানো হয় নজরুলকে। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার স্ত্রী কাকলী মণ্ডল সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন নজরুল মণ্ডল।

শ্রমিক নেতা তফাজ্জল হোসেন তপু তার লোক নয় দাবি করে নজরুল বলেন, সে হচ্ছে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা নুরু মণ্ডলের মামা। সে নুরু মণ্ডলের সঙ্গে রাজনীতি করতো। তবে তপুর সঙ্গে আমার তেমন খারাপ সম্পর্ক নেই।

নিজের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন নজরুল মণ্ডল। তিনি বলেন, বিরোধীদলে থাকার সময় নিজের গা বাঁচানোর জন্যই আমি এনজিওর চাকরি করেছি। আমার বাবার নামে এখনো ৩০০ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। গোয়ালন্দে মণ্ডল পরিবারের একটা ঐতিহ্য রয়েছে।

আপনি যখন নির্বাচন করতে চাইবেন তখন আপনার বিপক্ষের লোকজন এলোমেলো কথা বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। ঘাটের চাঁদাবাজির বিষয়ে বলেন, এটার সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই। এছাড়া এই চাঁদাবাজির সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয় স্বজনও জড়িত নয়। আমি পৌরসভার মেয়র হওয়ার আগেই ঘাটে আমার বাড়ি ছিল। সে হিসেবে হয়তো আমার বিরুদ্ধে মানুষ কিছু উল্টাপাল্টা বলতে পারে। আমি ২০১৪ সাল থেকেই গোয়ালন্দে সেটেল।

Back to top button