কয়েক গুণ বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠের আশুলিয়ার হাজারো মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল চক্রটি।এ চক্রের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব বলেছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে মানুষের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন প্রতারকেরা। এখন অনেকের টাকা দেওয়ার সময় হওয়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে পালিয়ে যান তাঁরা।
আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে র্যাব-৪–এর পরিচালক মো. মোজাম্মেল হক এক সংবাদ সম্মেলনে এ চক্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক বিনিয়োগের কথা বলে কোম্পানিতে বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের টাকা জমা নেওয়া হতো।
এ ক্ষেত্রে এফডিআর, ডিপিএস, সঞ্চয়ী পলিসি, পেনশন পলিসি, শিক্ষা পলিসি, হজ পলিসি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী পার্টনার পলিসিসহ নানা আকর্ষণীয় প্রস্তাব হাজির করেছিলেন তাঁরা। জমা টাকার ওপর বছরে ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ মুনাফা এবং স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রে ৩-৫ বছরে দ্বিগুণ অর্থ দেওয়ার লোভ দেখানো হয়েছিল। ওই এলাকার এক হাজারের বেশি মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন কষ্টে অর্জিত অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেছেন।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা সম্প্রতি মানববন্ধন করলে বিষয়টি র্যাবের নজরে আসে। পরে প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম (৩৫), সহসভাপতি ইকবাল হোসেন সরকার (৩৫), যুগ্ম সম্পাদক মমিন হোসেন (৩৫), কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ইব্রাহিম খলিল (৩৫), বিনিয়োগ কর্মকর্তা এস এম মকবুল হোসেন (৪০), সদস্য আল আমিন হোসেন (২৮), ফজলুল হক (৩৫) এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নুর হোসেন (২৭) ও মিজানুর রহমানকে (৩৮) গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রাহকের আস্থা অর্জনের জন্য সংস্থাটি প্রথম দিকে চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ দিত। তা দেখে লোকজন আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন। অনেকে নিজের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা, বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত টাকা সেখানে জমা রেখেছেন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত র্যাব-৪–এর একটি দল আশুলিয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করে। এ সময় সেখান থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত ভর্তি ফরম, প্রচারপত্র, সিল, বিভিন্ন ব্যক্তির নামে থাকা সঞ্চয়ের বই, চেক বই, নগদ টাকা ও মুঠোফোন জব্দ করা হয়।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া এসব অর্থ দিয়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে জায়গাজমি, বহুতল ভবন, বিভিন্ন ছোট–বড় কারখানা করেছেন বলে র্যাবের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিদেশে অর্থ পাচারও করেছেন।
এই কথিত সমবায় সমিতির সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহ এখনো পলাতক। র্যাব পরিচালক মোজাম্মেল হক বলেন, মুহাম্মদউল্লাহ আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বসবাস করলেও তাঁর বাড়ি ভোলায়। তাঁর বাবা ছিলেন গাড়িচালক। তিনি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
বলা হয়েছিল, আশুলিয়ায় গণবিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ঘোড়াপীর প্রকল্পে অনেক জমি রয়েছে। কিন্তু সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ জমি ছিল, যা ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার কোনো অনুমোদন না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ঋণ দিত।
ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় গ্রাহকদের মারধরও করতেন এ চক্রের সদস্যরা। তাঁরা আরও তিনটি নামসর্বস্ব কোম্পানি চালু করেছিলেন। সেগুলো হলো চেতনা পরিবার, চেতনা গার্ডেনিয়া (রিয়েল এস্টেট ব্যবসা) ও চেতনা পরিবার কল্যাণ ফাউন্ডেশন।
র্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য তাঁরা ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন বলে প্রচার চালালেও বিধিমোতাবেক তাঁদের ইসলামি শরিয়াহ বোর্ড ছিল না। এ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা সমিতির নামে রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও তা পলাতক সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহ, সদস্য তাজুল ইসলামের নামে নিবন্ধন করা হয়েছিল। জানা গেছে, তা ইতিমধ্যে বিক্রিও করা হয়েছে। ২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা।
আশুলিয়ায় সমিতির সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহর পাঁচতলা বাড়ি ও একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে সমিতির সহসভাপতি ইকবাল হোসেন সরকার তাঁর বন্ধু। আর সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা মাজহারুল ইসলামের সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় একাধিক বহুতল বাড়ি ও প্লট আছে। অন্যদেরও সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় একাধিক বাড়ি রয়েছে।
সমিতির বিগত কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলামের আশুলিয়ার ইসলামনগর এলাকায় একাধিক ভবন ও প্লট রয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয়, চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের নামে সংগৃহীত টাকা অবৈধভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে তাঁরা এসব সম্পদ করেছেন। কারণ, বছরের পর বছর মানুষের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয়েছে, তার কোনো হিসাব এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সাভার উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, গত জুন মাসের সর্বশেষ অডিট অনুযায়ী, এ সমিতির তহবিলে মাত্র ৬১ লাখ টাকা জমা রয়েছে।