নারীর উপর সহিংসতা : কারণ,প্রতিরোধ ও প্রতিকার
নারীর উপর সহিংসতা : কারণ ও প্রতিকার।নারী আমাদের মা, মেয়ে, বোন ও স্ত্রী। এদের স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা এবং স্ত্রীর সাহচর্য, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা ব্যতীত পুরুষ অচল। মানব সমাজের প্রাথমিক ইউনিট হ’ল পরিবার। যা একজন পুরুষ ও নারীর মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এই পরিবার থেকেই বেরিয়ে আসে ভবিষ্যৎ বংশধর। তারাই আলোকিত করে পরিবার এবং পরিচালিত করে সমাজ ও সভ্যতা। এখানে কারু প্রতি সামান্যতম অবমাননা ও বঞ্চনা পরিবারে ধস নামাবে। ফলে নেমে আসবে পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়। আজকের সমাজে সেটাই দেখা যাচ্ছে প্রকটভাবে।
সর্বত্র নারীর প্রতি অবমাননা ও তার উপর সহিংসতা চলছে অবিরতভাবে ক্রমবর্ধমান হারে। দেশে আইন-আদালত সবই আছে। নেই কেবল আল্লাহর বিধান ও তার যথাযথ প্রয়োগ। ফলে নারী এখন ইবলীসের সবচেয়ে অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে।দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। তাছাড়া এসব আইন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়।দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে পুরুষ তার স্ত্রী ব্যতীত অন্য সব নারীর প্রতি দৃষ্টি অবনত রাখবে এবং নিজের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে। আর আল্লাহ সবার কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ নূর ২৪/৩০)। অন্যদিকে নারী তার স্বামী ব্যতীত অন্য সব পুরুষের প্রতি দৃষ্টি অবনত রাখবে এবং তার লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে নূর ৩১)। তার সর্বাঙ্গ সতরের অন্তর্ভুক্ত। কেবল সাংসারিক কাজকর্ম, ওযূ ও চিকিৎসার মত প্রয়োজনে হাত ও পায়ের পাতা এবং চেহারা খুলবে আবুদাঊদ হা/৪১০৪)। কিন্তু পরপুরুষের সামনে সেটাও নিষিদ্ধ। এমনকি হজ্জের সময়ও নারী তার চেহারাসহ সর্বাঙ্গ ঢাকবে ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/২৬৯০)। সে এমনভাবে চলবে না যাতে তার গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়নূর ৩১)। এগুলি হ’ল আল্লাহর বিধান। সমাজে অনেক পুরুষ ও নারী আল্লাহর উক্ত বিধান মানেন না। ফলে ক্রমেই পশুত্ব মাথা চাড়া দিচ্ছে ও মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
দেশে নারীর শাসন চলা সত্ত্বেও এ ধরনের নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত এদেশে নারীর কোন নিরাপত্তা নেই। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাই বর্তমানে বেশী নারী নির্যাতনকারী।দেখা যায় সমাজের শিক্ষিত, সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষ দ্বারাই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। তার চিত্র সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি। সারা বিশ্বে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীরা একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এ নিয়ে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছিলো আলোড়ন। এ আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছিলো #মি টু। কিন্তু কতখানি ফলপ্রসূ এ আন্দোলন? প্রশ্ন থেকেই যায়। সফলতা পাওয়া গেলেও তা সম্পূর্ণ কি? সঠিক উত্তর পাওয়া কষ্টসাধ্য। বরং দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনকারীরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সাম্প্রতিককালে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি চিত্র তুলে ধরলে অনেকখানি পরিষ্কার হওয়া যাবে। ইউনাইটেড নেশন পপুলেশন ফান্ডের জরিপে বলা হয়, নারীর ওপর তার পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃত্যু ঘটছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারণে। শতকরা ৬১ জনের বেশি পুরুষ এখনও মনে করে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করা বৈধ। এছাড়া, নারীর প্রতি শতকরা ৮০ ভাগ সহিংসতা ঘটে পরিবারের ভেতরে। অন্যদিকে দেশে সংঘটিত মোট খুনের ঘটনার ৫০ ভাগই হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার ঘটনা। নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চলে। শহরাঞ্চলেও শতকরা ৬০ ভাগ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। মৌখিক নিপীড়নের শিকার হন ৬৭ শতাংশ নারী। তাছাড়া যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে ছয়শটি।
কিছু নারী প্রগতির নামে বেহায়াপনায় আনন্দ পায়। অতঃপর পুরুষ যখন তাকে টীজ করে, ধর্ষণ করে, হত্যা করে, তখন চারদিক থেকে হায় হায় রব ওঠে। অথচ আসল কারণ যে সে নিজেই, সেটা কেউ দেখেন না। পর্দাহীন নারীর প্রতি পরপুরুষ প্রলুব্ধ হবেই। এই অমোঘ সত্যকে উপেক্ষা করে যারা প্রগতির দোহাই দিয়ে নারীকে নগ্ন বানিয়ে দর্শন লালসা চরিতার্থ করে, তারা পশুর চাইতে অধম। এরাই নারীর আসল দুশমন। অথচ আত্মসম্মান বোধহীন নারীরা নিজেরাই নিজেদেরকে পরপুরুষের ভোগ্যবস্ত্ততে পরিণত করছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। অতএব নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করার জন্য আল্লাহর বিধান পূর্ণরূপে অনুসরণ ও তাঁর দন্ডসমূহ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।
সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। নারীদের কথা বলতে হবে নিজের অধিকার আদায়ে। নির্যাতনকারী সমাজের যেই হোক না কেন, জোরালো কণ্ঠে কথা বলতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। সচেতন হতে হবে নিজেদের প্রকৃত অধিকার প্রসঙ্গে। সচেতন হতে হবে শিক্ষা ও চিন্তায়। সর্বোপরি নারীকে নারী নয়, যখনই তাদের মানুষ হিসেবে দেখা হবে তখনই অনেকাংশে কমে আসবে নির্যাতন।