‘আম্মু তুমি ফিলিস্তিনের মায়েদের মতো মনকে শক্ত করো’

আন্দোলনের শহীদ মুগ্ধের কবরের পাশেই দাফন করা হয় শহীদ রিয়াদকে

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের হাজারো শহীদের একজন হলেন টঙ্গী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিদওয়ান শরিফ রিয়াদ জয়। তাদের বাড়ি টঙ্গীতেই। আন্দোলনে না যেতে একমাত্র ছেলেকে বারবার বারণ করেছিলেন মা রুপালী আক্তার বিউটি। কখন কী হয়ে যায়, এ আশঙ্কা তাকে সব সময়ই তাড়া করত। কিন্তু কোনোভাবেই ২০ বছর বয়সি ছেলেকে আন্দোলনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেননি।

উল্টো ছেলে তাকে বলেছিল, ‘আম্মু তুমি ফিলিস্তিনের মায়েদের মতো মনকে শক্ত করো। তোমার ছেলে তো একা না। আরও হাজারো মায়ের সন্তান আছে আন্দোলনে’। জয়কে কোনোভাবেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা যাবে না বুঝতে পেরে, বড় বোন শিমু আক্তার তার ভাইকে বলেছিলেন, আন্দোলনে গেলে মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। উত্তরে জয় বলেছিল, আম্মুতো দৌড়াতে পারবে না। যদি কাঁদানো গ্যাস ছোড়ে তখন আম্মুর হাঁপানি উঠে পড়ে যাবে। এ যুক্তি দিয়ে মাকে রেখেই বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিতে থাকে জয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আল্লাহ যেন হেফাজত করেন এবং বিজয় দান করেন, সেজন্য পরদিন শুক্রবার মসজিদে কিছু টাকা দান করার নিয়ত করেন জয়ের মা। অন্যদিকে বন্ধু ইয়াসিন আরাফাত শিমুলকে জয় মেসেজ করে বলেন, ‘ভাই চোখের সামনে কত পোলাপানরে হত্যা করল, কিছুই করতে পারলাম না’। পরদিন শুক্রবার থেকেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জয়।

পরদিন জয় মসজিদে যাওয়ার সময় তার মা তার হাতে ৫০ টাকা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা মসজিদে দিও’। ছেলেকে মসজিদে পাঠিয়ে মা রান্না করছিলেন। কিন্তু জুমার নামাজ শেষ হলেও জয় বাসায় ফিরে না আসায় উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে মায়ের।

সেদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাট ডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে বন্ধুদের নিয়ে তুরাগের রাজাবাড়ী থেকে অটোরিকশায় উত্তরা বিএনএস সেন্টারের দিকে রওনা হন জয়।

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ সড়কের সামনে গিয়ে তাদের দেখা হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী মেডিকেল টিমের সঙ্গে। তারা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য উত্তরা বিএনএস সেন্টারের দিকে যাচ্ছিলেন ফার্স্ট অ্যাইড বক্স নিয়ে। তাদের দেখেই জয় আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা সেবায় সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যুক্ত হন মেডিকেল টিমটির সঙ্গে। একটি ফার্স্ট অ্যাইড বক্স নিয়ে এগোতে থাকেন সামনের দিকে।

উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজর সামনে পৌঁছতেই কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী মেডিকেল টিম দেখেই বলে ওঠেন, ‘সামনের দিকে খুব খারাপ অবস্থা, অনেকেই আহত। কেউ যাবেন প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে? এ প্রশ্ন শুনেই জয় যেতে রাজি হন। সে শিক্ষার্থীরা ব্যাগ থেকে কয়েকটি প্রাকটিক্যাল খাতা বের করে জয়কে বললেন, বুকে ও পিঠে বেঁধে রাখতে। জয়ের সঙ্গে তার বন্ধুরাও সামনে গিয়ে কয়েকজন আহত শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে সহায়তা করেন।

এদিকে মা রুপালী আক্তার বারবার কল করে যাচ্ছিলেন জয়ের ফোনে। ৫টা ৩২ মিনিটে জয় মাকে ফোন করে বলেন, ‘আম্মু আমি এলাকায় আছি, সন্ধ্যার আগেই চলে আসব’। ছেলের কথা শুনে আশ্বস্ত হন মা। এরপর জয় বন্ধুদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। কাঁদানো গ্যাসের তীব্র ঝাঁজ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে তাদের সঙ্গে থাকা টুথপেস্ট বিতরণ করছিলেন তারা। এমন সময় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করতে করতে সামনের দিকে আসে। তাদের সঙ্গে ছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীরাও।

জয়ের সঙ্গে বন্ধুরা ও মেডিকেল টিমের সদস্যরাও বিএনএস সেন্টারের মহাসড়ক থেকে ২৮ নম্বর সড়ক হয়ে ২৭ নম্বর সড়কের দিকে এগোচ্ছিলেন। এ সময় বন্ধু সাকিব আহমেদ জয়কে সাবধান করে দিয়ে বলে, জয় গুলি করছে, তাড়াতাড়ি আয়। জয় উত্তরে বলেছিল, ‘শাকিব ভয় পাইস না, এখন মরলে শহীদ হইবি’।

মুহুর্মুহু গুলির মধ্যে গাছের আড়ালে যান জয় ও শাকিব। হঠাৎ শাকিব দেখতে পান জয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। জয়কে ধরতে সামনে এগোতেই শাকিব নিজের শরীরেও রক্ত দেখতে পান। বুঝতে পারেন তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর কী হয়েছে, তা আর মনে করতে পারেননি প্রাণে বেঁচে যাওয়া শাকিব। এদিকে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ জয়ের নিথর দেহ দ্রুত শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও জয় বাসায় না ফেরায় মা ৬টা ১৯ মিনিটে আবারও ফোন দেন ছেলেকে। কিন্তু ফোন ধরেননি জয়। মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পর অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে জয়ের মায়ের মোবাইলে। বোন শিমু কল রিসিভ করতেই অন্য প্রান্ত থেকে কেউ বলেন, জয় গুরুতর আহত, আপনারা কেউ মনসুর আলী মেডিকেলে আসতে পারলে ভালো হয়।

ফোন পেয়েই জয়ের বাবা-মা দ্রুত সে হাসপাতালে গিয়ে পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। কয়েক মিনিট পর একজন চিকিৎসক এসে তাদের জানান, শাহাদত বরণ করেছেন জয়। কিন্তু তার মা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তার কথা। এরপর জয়ের ছবি দেখে তার বাবা নিশ্চিত হন জয় আর বেঁচে নেই। জয়ের মা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে চিৎকার করে ছেলে হত্যার বিচার চাইছিলেন আল্লাহর কাছে।

এমন সময় একজন চিকিৎসক বলেন, কান্না করবেন না মা, তাহলে আপনার ছেলের লাশ পুলিশ বা আওয়ামী লীগের লোকেরা এসে নিয়ে যাবে।

অ্যাম্বুলেন্সে লুকিয়ে প্রধান সড়ক এড়িয়ে শহীদ জয়ের লাশ বাড়িতে আনা হয়। কিন্তু সেখানে তার লাশ দাফনে বাধা দেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ ও মেয়র আতিকুল ইসলামের সন্ত্রাসী বাহিনী শহীদের বাসার সামনে অবস্থান করছিল। নিজেরা দাফন করবে বলে জয়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা।

এ নিয়ে সেখানে শহীদ জয়ের বন্ধু আদিত্য চৌধুরীসহ উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এরপর ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী এগিয়ে এলে রাত ১২টায় জানাজা শেষ করে কামারপাড়া বামনারটেক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জুলাই আন্দোলনের আরেক শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের কবরের পাশেই দাফন করা হয় শহীদ রিদওয়ান শরীফ রিয়াদকে।

জয় স্বপ্ন দেখতেন ক্রিকেটার হওয়ার। কিন্তু নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায়ই জয় বুঝতে পারেন, তার এ স্বপ্ন আর্থিক কারণে পূরণ করা সম্ভব হবে না। বাবাকে সহযোগিতা করতে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থাতেই জয় একটি সমিতিতে পার্ট টাইম চাকরি নেন। তার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা অর্জন করে পরিবার ও দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার। কিন্তু ঘাতকের বন্দুকের গুলি কেড়ে নিয়েছে তার জীবন।

জয়কে হত্যার ঘটনায় মামলা কেন করা হয়নি- তা জানতে চাইলে জয়ের বোন শাহানাজ আহমেদ শিমু জানান, আমরা কোনো বিচার চাই না এখানে। বিচার একদিন হবে আল্লাহর কাছে। শেষ দিবসের বিচারের অপেক্ষায় থাকব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button