স্বৈরাচারের শৃঙ্খল ভেঙে কোন পথে সিরিয়া ?
সিরিয়ায় স্বৈরাচারী বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের সশস্ত্র অভিযানে ধরতে গেলে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম, যারা সংক্ষেপে এইচটিএস গোষ্ঠী নামে পরিচিত। সশস্ত্রগোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান হচ্ছেন আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। রোববার (৮ ডিসেম্বর) এইচটিএস এক বিবৃতিতে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের দীর্ঘ দুই দশকের স্বৈরশাসনের পতনের ঘোষণা দেয়।
এতে বলা হয়, অত্যাচারী এবং জালিম শাসক বাশার আল-আসাদ দেশ থেকে পালিয়েছেন। গোটা সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্ধকার যুগের পরিসমাপ্তি হলো। আর শুভ সূচনা হলো একটি নতুন যুগের।
দেশটির একনায়কতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে ইরান ও রাশিয়ার শক্তিশালী সমর্থনের ওপর ভর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। আসাদের শাসনের পতনের পর এইচটিএসপ্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এককভাবে সিরিয়ার নেতৃত্বে উঠে আসেন। এতে দেশটি ফের গভীর সংকটে জড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবার সেই সংকট কেবল সিরিয়ার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই আসাদ সরকারের পতন ফলে সিরিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং অরাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠবে। একদিকে যেমন কট্টরপন্থী ইসলামী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, অন্যদিকে বিশ্বের শক্তিধর দেশসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় ফের দ্বন্দ্বে জড়াবে। এমন সংঘাত-সহিংসতা হয়তো বা সর্বাত্মক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এইচটিএসনেতা আল-জোলানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সশস্ত্র গোষ্ঠীটি যা একসময়ে নিষিদ্ধ সংগঠন আল-কায়েদার অংশ ছিল, এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পরপরই এখন নিজেদের মধ্যপন্থী (ইসলামপন্থী) শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। জোলানি কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার পথে এগোতে সম্মত হলেও, তার অতীত কর্মকাণ্ড এবং গোষ্ঠীটির আদর্শ চরমপন্থী অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
‘সিরিয়া এখনও বিপদমুক্ত নয়,’ বলে মন্তব্য করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ। সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে তিনটি প্রধান উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি। সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা এখনও হুমকির মুখে। ২০১১ সালে আরব বসন্ত থেকে আরব বিশ্ব যে সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলার চক্রে আটকে যায়, তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি আসাদ শাসনের পতনের জন্য মূলত রাজনৈতিক সংস্কারের অভাবকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘রাজনীতি ও নীতিমালার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা হয়েছে। আসাদ সরকার বিভিন্ন আরব দেশ থেকে, যার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতও রয়েছে, যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা কাজে লাগাননি। তিনি সংবিধান নিয়ে চলমান আলোচনায় অগ্রগতি আনেননি এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই পরিস্থিতি আসলে একটি বিশাল রাজনৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ। আমরা শাসনের দ্রুত পতন প্রত্যক্ষ করেছি, যার একটি বড় কারণ রাজনৈতিক ব্যর্থতা। আমাদের সতর্কতামূলক নজর রাখতে হবে। আমরা সেখানে বিশৃঙ্খলা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা চরমপন্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা এখনও সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বিগ্ন,’ যোগ করেন তিনি। বিবিসির প্রতিবেদক বারবারা প্লেট উশার দামেস্ক থেকে জানিয়েছেন, সেখানে অনেক মানুষ ভীত, বিশেষ করে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়, শাসনব্যবস্থার সমর্থক এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
তিনি বলেন, ‘লেবানন সীমান্তে আমরা একজনের সঙ্গে দেখা করেছি যিনি চরম হতাশায় কাঁদছিলেন। তিনি বিদ্রোহীদের টার্গেট হওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। তিনি তার পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয়, অনেকেই আগামী কয়েক দিন নিঃশব্দে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন।’
কট্টরপন্থীদের উত্থানের শঙ্কা: আসাদের পতনের পর জোলানি যদি ক্ষমতায় আসেন, তাহলে সিরিয়া আরও কট্টর ইসলামপন্থী দেশ হয়ে উঠতে পারে। যদিও এইচটিএস প্রথম থেকেই ইরানের মতো শিয়া শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, তবে তাদের আদর্শগত অবস্থান একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে যেখানে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হবে সেই গোষ্ঠীর নিজস্ব ব্যাখ্যা মেনে। তারা আগেও জানিয়েছে, সিরিয়ায় অমুসলিম এবং খ্রিস্টানদের আর জায়গা হবে না। এই পরিস্থিতিতে দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অস্তিত্ব সংকট দেখা যেতে পারে।
তবে, এইচটিএসের সাম্প্রতিক কৌশলগত অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে ইচ্ছুক। জোলানি তার সংগঠনের বিরুদ্ধে চরমপন্থীর যে তকমা রয়েছে তা মুছে ফেলতে চাইছেন। কিন্তু এটি কতটা সফল হবে তা অনিশ্চিত।
ইরান-বিদ্বেষ এবং মধ্যপ্রাচ্যে নয়া সমীকরণ: আসাদ সরকারের পতনের ফলে ইরানের জন্য একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে। সিরিয়ার ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে তেহরান দীর্ঘদিন ধরে লেবাননের হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু এইচটিএস এবং আল-জোলানি সুন্নিপন্থী আদর্শের হওয়ায় ইরানের শিয়া নেতৃত্বাধীন অবস্থানের বিরোধিতা করতে পারে।
এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি শক্তির সমীকরণ তৈরি করতে পারে। একদিকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাববলয় ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠবে, অন্যদিকে সৌদি আরব এবং তুরস্কের মতো সুন্নি শক্তিগুলো এইচটিএসের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। ঘোষিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও জোলানি যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
ইরান-বিরোধী অবস্থান আরও জোরালো হয়ে উঠবে। নতুন নেতৃত্বে সিরিয়া ইরানের প্রভাবমুক্ত একটি দেশ হয়ে উঠতে পারে। তবে, এটি ইরান-সৌদি সংঘাতকে আরও জটিলতর করে তুলতে পারে।
তুরস্কের ভূমিকায় পরিবর্তন: এইচটিএস এবং তুরস্কের মধ্যে ইতোমধ্যে সহযোগিতার আভাস পাওয়া গেছে। জোলানির নেতৃত্বে আঙ্কারার জন্য কৌশলগত মিত্র হয়ে উঠতে পারে দামেস্ক।
উদ্বেগ বাড়ল ইসরায়েলেরও: এবার ইসরায়েল এমন এক সিরিয়ার মুখোমুখি হবে যেখানে একটি সুসংগঠিত সুন্নিপন্থী ইসলামী গোষ্ঠী নেতৃত্ব দিবে। তারা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের নতুন ভূমিকা: জোলানি যদি কট্টরপন্থী অবস্থান ছেড়ে মধ্যপন্থী হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো তাকে ‘প্রয়োজনীয় মিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। তবে, এটি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা নাও দিতে পারে।
নয়া ফাঁদ: সিরিয়া যদি এইচটিএসের নেতৃত্বে চলে যায়, তবে দেশটিতে গভীর বিভাজন এবং সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পরতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজন এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সিরিয়াকে একটি স্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে।
কর্তৃত্ববাদী আসাদের শাসনের পতনের পর সিরিয়ার জনগণের ভাগ্য এখন আল-জোলানির নেতৃত্বের ওপরই নির্ভর করবে না। বরং এটি নির্ভর করবে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থান, সিরিয়ার জনগণের রাজনৈতিক চেতনা এবং এইচটিএসের চরমপন্থী পরিচয়ের গ্রহণযোগ্যতার ওপর।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ বলতে গেলে আরও জটিল এবং অজানা পথের দিকে এগোচ্ছে। আল-জোলানি যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন, তবে তার নেতৃত্বের ধরণ, আদর্শ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশলই ঠিক করবে দেশটি আরও সংকটময় হয়ে উঠবে, নাকি একটি মধ্যপন্থী ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তবে আঞ্চলিক শক্তির সমীকরণ এবং দেশটির জনগণের স্বদিচ্ছা এবং মনোবলই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে দেশটির ভাগ্য।