শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা পালিয়ে গেলেও সক্রিয় আছে সিআরআই
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা পালিয়ে গেলেও সক্রিয় আছে সিআরআই। যার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে প্রকাশ্যেই। বাংলাদেশের মোট ১৪৮টি অ্যাকাউন্ট ও পেজ ফেসবুক থেকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সরায় মেটা। মেটার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভুয়া পরিচয়ের এসব অ্যাকাউন্ট ও পেজ বিষয়ে মেটা যে অনুসন্ধান করেছে, তাতে এগুলোর সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। (বিবিসি ৩১ মে, ২০২৪)
মেটা তার রিপোর্টে বলেছে, সমন্বিত অনির্ভরযোগ্য আচরণের জন্য আমরা ফেসবুক থেকে পঞ্চাশটি অ্যাকাউন্ট ও ৯৮টি পেজ সরিয়ে ফেলেছি। এই নেটওয়ার্কটি বাংলাদেশেরই এবং তারা বাংলাদেশের স্থানীয় অডিয়েন্সকে টার্গেট করেছিল। এসব অ্যাকাউন্ট ও পেজগুলোর মোট প্রায় ৩৪ লাখ ফলোয়ার ছিল। একই সাথে এসব পেজ থেকে প্রায় ৬০ হাজারের ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিজ্ঞাপনে ব্যয় করা হয়েছে।
গত ৩১ জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেসবুকে সালমান এফ রহমান ৭০৭টি পোস্ট বুস্ট করায় ২৬ হাজার ৯৭৫ ডলার এবং জুনাইদ আহমেদ পলক ৪৯১টি পোস্ট বুস্ট করে ২৬ হাজার ৮৬৩ ডলার ব্যয় করেছেন। তাদের অধিকাংশ পোস্ট ছিল বিএনপি এবং তারেক রহমানকে হেয় করার চেষ্টায়।
অপপ্রচারের পেছনে সিআরআই
বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিআরআই। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) জন্য করা এক প্রতিবেদনেও মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও সিআরআই-সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজ থেকে নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজিতে পোস্ট দেয়া হতো। এর মধ্যে থাকত সংবাদ, সাম্প্রতিক ঘটনা, নির্বাচন, বিএনপির সমালোচনা, বিএনপির দুর্নীতির অভিযোগ ও নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায় বিএনপির ভূমিকার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের পক্ষে মন্তব্যসহ নানা পোস্ট।
সিআরআইয়ের চেয়ারম্যান শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ভাইস চেয়ারম্যান।
ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে আরো রয়েছেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। পরিবারটির বাইরে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে আছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। শেখ পরিবার ও দলের হয়ে গবেষণা সংস্থাটির সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন তন্ময় আহমেদ।
সিআরআই হোয়াইট বোর্ডের সম্পাদকীয় পরিষদে কো-এডিটরের দায়িত্বে রয়েছেন সৈয়দ মফিজ কামাল ও কপি এডিটর রুথ গ্রিফিথস। ম্যাগাজিনটির ওয়েবসাইটে পরামর্শক পর্ষদের সদস্য ১০ জনক। তাদের মধ্যে প্রথমেই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সিআরআইয়ের প্রধান কার্যালয় ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ২ নম্বর ভবনে। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয় ও ধানমন্ডি ৬/এ-তে আরো দুটি কার্যালয় রয়েছে সিআরআইয়ের।
সূত্র জানায়, বিপু ছিলেন সিআরআইয়ের মূল অর্থদাতা। আওয়ামী লীগ আমলে জ্বালানী খাতে লুটপাটের অর্থ সিআরআইয়ে এসেছে।
সিআরআই সরাসরি আওয়ামী লীগের গবেষণা শাখা
সিআরআই এবং এর ট্রাস্টিরা বরাবর প্রতিষ্ঠানটিকে অরাজনৈতিক এ অলাভজনক বলে দাবি করেছে। তবে অনুসন্ধানের প্রমাণিত হয়েছে সিআরআই সরাসরি আওয়ামী লীগের গবেষণা শাখা। আওয়ামী লীগের বর্তমানে আনপাবলিশড ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “CRI (Centre for Research & Information), the research wing of Bangladesh Awami League”।
আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজটিও পরিচালনা করে সিআরআই। ভেরিফায়েড পেইজটির page transparency তে ‘Organisations that manage this Page’ এর জায়গায় ফেসবুক উল্লেখ করে দিয়েছে “Centre for Research and Information is responsible for this Page”. মানে, আওয়ামী লীগের অনলাইন প্রচারণার সবচেয়ে বড় অফিসিয়াল প্লাটফর্ম এই ফেসবুক পেইজটি পরিচালনা করে দলটির অফিসিয়াল ‘গবেষণা শাখা’ বলে পরিচিত সিআরআই।
CRI অফিসিয়াল একটি প্রকাশনা হচ্ছে WhiteBoard নামে একটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ম্যাগাজিন। এর আনপাবলিশড ওয়েবসাইটে ম্যাগাজিনটিকে সিআরআইয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রকাশনা বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের গবেষণা শাখা হওয়ার পরও, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর সিআরআইয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে। যা অনুযায়ী, সারাদেশে ‘শেখ রাসেল কম্পিউটার অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব` এর অধীনে স্থাপিত দুই হাজার ডিজিটাল ল্যাবের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধায়নের জন্য সিআরআই সমন্বয়ক ও তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। পরবর্তী সময়ে ১০ হাজার ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। যা নিয়ন্ত্রণ করেছে সিআরআই।
প্রথম পাঁচ হাজার ল্যাব স্থাপনে পরামর্শকের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ কেনাকাটা বাবদ ৬৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, ল্যাব ও পিআইইউ স্থাপন বাবদ ১৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনা বাবদ ২৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং শিক্ষা ও শিক্ষণ উপকরণ বাবদ ১৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়।
যেভাবে অপপ্রচার
‘হাইপার জসিম’ নামে ফেসবুক পেজে তারেক রহমানকে বিদ্রুপ করে তৈরি করা অ্যানিমেশন পোস্ট করা হয়। সেখানে একটি ফোন নম্বর পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে পাওয়া যায় নম্বরটি আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের সমন্বয়ক প্রকৌশলী তন্ময় আহমেদের। তিনি সাইবার দুনিয়ার রাজনীতির ছায়া যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন। তন্ময় জানালেন, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেজ থেকে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য, দলের কর্মসূচি, নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার করা হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা তাদের মতো কাজ করেন। হাইপার জসিম তেমনই একটি পেজ।
তন্ময় আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আওয়ামী লীগও কি যে কোনো কনটেন্ট ভাইরাল করতে সক্ষম? তিনি বলেছেন, যে কোনো তথ্য তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে তিনি বলেছেন, দলীয় একটি স্টুডিও রয়েছে। সেখান থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। বুস্টের ডলার কে দেয়– প্রশ্নে তিনি বলেছেন, অধিকাংশ পেজ নিজেরাই আয় করছে। তা দিয়ে বুস্ট করতে পারে। বক্তব্যে কিছুটা ‘টুইস্ট’ আনা হয়, যাতে দলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কনটেন্টটি মিলে যায়।
৫ আগস্টের পরও ফেসবুকে বিএনপি, তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে একের পর এক প্রচারনা এবং গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ফেসবুকে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব না থাকলেও, ডলার খরচ করে বুস্ট করার কারণে তা অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে ছড়ায়। এমন অন্তত ১০০টি পেইজ এবং অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে গুজব ছড়ানোর কারণ ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ নেতা এবং সংগঠনটির ভেরিফায়েড পেইজ ফেসবুক থেকে বন্ধ করে মেটা।
এএফপির ফ্যাক্ট চেকার কদরুদ্দিন শিশির জানিয়েছেন, ওই সময়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ৯৮টি পেইজ এবং অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়েছে। ৫ আগস্টের পরও একই প্রক্রিয়ায় অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ডলার খরচ করে বুস্ট করার কারণে, ফেসবুকে খুললেই এই এসব অপতথ্য প্রথমেই দেখতে পাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।