চার দশক আগে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ফার্স্ট লেডি ছিলেন ইমেলদা মার্কোস। ইমেলদার হাজারো জোড়া জুতার গল্প শোনা যায়। কিন্তু পোশাকের সৌখিনতার বাইরে তার ছিল দেশ-বিদেশে বেড়ানোর বাতিক। ইমেলদার বিদেশ ভ্রমণ সে সময় বেশ সাড়া ফেলে ছিল। ক্ষমতা ঠেকাতে যখন ফিলিপাইনে জরুরি অবস্থা, তখন ইমেলদার সঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সেতুংয়ের সঙ্গে আন্তরিক একটি ছবি রাজনৈতিক আলোচনায় খোরাক যোগায়।
যদিও প্রায় ২১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিতর্কিত নির্বাচনের পর জনরোষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক ও তার স্ত্রী ইমেইলদার। অনেকটা শেখ হাসিনার মতই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে গত আগস্টের ৫ তারিখ ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিশাল বহর সঙ্গে করে বিদেশ সফর নিয়েও বিতর্ক ছিল তার আমলে। কিন্তু এ সংক্রান্ত খরচ গোপনীয়তার সঙ্গে হওয়ার কারণে এর অর্থনৈতিক বা রাষ্ট্রের কি পরিমাণ অর্থ সেখানে ব্যয় হয় তা নিরূপণ করা কখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় নেবার পর বিষয়গুলো সামনে আসতে থাক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফরে গেলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ভাড়া করতেন সরকারি টাকায়। রীতি অনুযায়ী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখভাল করতেন বলে জানিয়েছেন বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেবার পর থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি কোথায় কতবার গিয়েছেন তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। এর আগে বিমানের কাছে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হলে তা ক্লাসিফাইড উল্লেখ করে আবেদনটি বাতিল করে দেওয়া হয়।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কী বলছে?
বিমানের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে সফরকালে বিমানের বোয়িং ৭৭৭, ৭৮৭ সিরিজের অত্যাধুনিক বিমানে সফর করতেন। তবে কখনো কখনো সিডিউল ফ্লাইটেও আসা যাওয়া করেছেন শেখ হাসিনা।
বিমান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব সফরে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বয়ং ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রটোকল হিসেবে রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানের সঙ্গে ভিভিআইপি ফ্লাইটে সফর করতেন। বিশাল বিমান নিয়ে শেখ হাসিনা যেতেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বিমানের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন সব দেশে নিয়ে যাওয়া হতো যেখানে নিয়মিত পরিচালিত বিমানের ফ্লাইট কিংবা অন্য কোনো উড়োজাহাজ নিয়মিত যাত্রী হিসেবে সেসব গন্তব্যে গেলে রাষ্ট্রের প্রচুর সাশ্রয় হওয়া সম্ভব ছিল।’
তার (শেখ হাসিনা) শাসনামলে তিনি উড়োজাহাজে উড়ে কি পরিমান অর্থ খরচ করেছেন অনুসন্ধান করে তার কেবল পাঁচ বছরের হিসাব মিলেছে।
অনুসন্ধান বলছে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থাটি আড়াইশো কোটি টাকা ব্যয় করে ৪৮টি ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে।
এর মধ্যে ৩৫টিই শেখ হাসিনার সফর সংক্রান্ত। বাকি ১৩টি ঘটনায় দুজন রাষ্ট্রপতি সরকারের পক্ষ থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া করে তাদের সফর সম্পন্ন করেন।
এসব সফরে শেখ হাসিনা ব্যয় করেছেন প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর বাকি ৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চপ্পু।
এ সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনা অন্তত আটবার যুক্তরাজ্যে সফর করেন। ভারতে গিয়েছেন অন্তত চারবার। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে চারবার করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নাতে দুইবার করে সফর করেন শেখ হাসিনা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ২০২৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরে। তখন প্রায় ২৩ কোটি টাকার কাছাকাছি ব্যয় হয়। এ সমস্ত বিল সাধারণত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয়টি দেশে ৯ বার সফর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তাতে খরচ হয় সাড়ে ২৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল থেকে ২৪ সালের মধ্যে ছয় দেশে পাঁচবার সফর করে বর্তমান রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন খরচ করেছেন সাড়ে ২৫ কোটি টাকা।
বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো সাফিকুর রহমান জানান, সরকার বিমানের কাছ থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়।
অন্যদিকে, বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশাল বহর নিয়ে তিনি ( শেখ হাসিনা) সফর করতেন। অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল প্রতিটি সফর।’
বিমানের আরেক কর্মকর্তা বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় বিমানের পক্ষ থেকে সরকারকে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের বিমান কিনে তা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হয়।’
‘আমরা বলি যে বিমানটি আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। নিয়মিত ফ্লাইটের পাশাপাশি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য প্রস্তুত থাকবে।’ যোগ করেন তিনি।
করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশ সফরের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হলেও, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ধরনের বিলাসবহুল সফরে কৃচ্ছতা সাধনে বিশেষ কোনো নজির দেখা যায়নি।
ড. ইউনুস কী করেছেন?
অভিযোগ রয়েছে প্রতিবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদানের সময় বিশাল বহর নিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো অংশগ্রহণের সময় নিজের বিশাল প্রটোকল নিয়ে যাবার তথ্যও রয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি নিয়মিত বিমান ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সফর করেছেন। নিরাপত্তার বাইরে সংকুচিত করেছেন তার সফরসঙ্গীর সংখ্যা।
রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের এই ব্যাপারে শেখ হাসিনার কোনো বক্তব্যও নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে নিয়মিত ফ্লাইটে সফর করে ব্যয় সংকোচন করা যেতো কিনা এমন প্রশ্ন রেখে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এই ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ ধরনের বিদেশ সফর বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে যেমন লুটপাট হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে তার ধারাবাহিকতা-ই এমন বিমান বিলাসিতা। যে সরকার-ই আসুক বা রাষ্ট্র পরিচালনা করুক তাদের উচিত হবে জনগণের টাকায় বিমানের এমন ব্যবহার পরিহার করা।
২০২৩ সাল পর্যন্ত বিমানের প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সরকারের কাছে। জুলাই মাসে সর্বশেষ বিশাল বহর নিয়ে চীন সফরে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও দীর্ঘ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ বিদেশ সফর বাতিল করেন। আর ৫ তারিখ নিয়মিত ফ্লাইট নয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সামরিক উড়োজাহাজে করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।