কবি পরিচিতি:
আদ্যনাথ ঘোষ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত পদ্মার তীরবর্তী নিসর্গ সৌন্দর্যশোভিত গ্রাম হেমরাজপুরে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বীরমুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ কুমার ঘোষ এবং মাতা নিভা রানী ঘোষ। পেশা: শিক্ষকতা। কবিতাগ্রন্থ ১২টি। উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে, দূর জংলার গান।
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা
পরাস্ত জীবনের পাঠ
পরাজিত জীবনের কাছে কেউ নেই আজ।
তবু কেন উচ্ছন্নের সংসার দিনশেষে মেপে চলে
সটান শরীরের অসহ্য ক্ষত
ফেলে আসা দিনের ঘুমহীন পাঠের ভেতর।
কুড়িয়ে পাওয়া সময় কি মনে রাখে
বিষণ্ন জীবনের যুথবদ্ধ শ্লোক।
নির্মোহ মানুষ থেকে ঢের বেশি ভালো
ক্ষমাহীন অন্ধ সময়!
কেননা সংসার জ্বালায় পরাস্ত হয়
মানুষের বিদগ্ধ হৃদয়।
যেখানে আড়ালেরা আড়ালেই থাকে
মৃত কোনো প্রাণীর মতোন
নিঃসঙ্গ রোদের তামাটে অন্ধকারে।
যদিও ব্যথার আকাশ পুড়ে যায় শূন্যতার অন্ধপথে-
তবু কেন নিয়তির দৃষ্টিতে ভরে ওঠে
অলিখিত জীবনের ঝাপসা দৃষ্টির
অনন্ত গহন সময়।
ওরে ও অন্ধপাখির সীমাহীন ক্ষত
তুমিও কি মায়াবী আলোর হাতছানি রেখে
ফেলে যাও উড়ন্ত সময়ের তামাটে অন্ধকার।
বৃন্দাবনী আরঙ
এতোসব উন্মাদ বসন্তেও ভেসে আসে কষ্টের সানাই-
রঙেরা ফেরায় মুখ গোপন অসুখে- জীবন কষ্টের বিষণ্ন হাওয়ায়-
আমার ফাগুনের ইচ্ছেডানার শরীরের রঙে-
আমার সুরতোলা ভৈরবীর ঘুমঘুম হাওয়ায়।
যে বাতাস একদিন পাখিদের ডানায় উড়ে চলে জোছনার দেহে-
যে আবির একদিন উড়ছিল ফাগুন ফোটার সময়-
সে আজ কেউটের ফনায় দিনমাপে আঁধারের দেহে-
ঘুমন্ত বাসর হয়ে আকন্দের কাঁটায়- কালিন্দীর পোড়াদহ ছুঁয়ে।
একদিন চন্দ্রমল্লিকার ঝোপে ফুটেছিল থোক থোক প্রজাপতি ফুল-
কৃষ্ণচূড়ার রঙ মেখেছিল পূর্ণিমা চাঁদ- সে এখন ঘোমটা খোলা বিষাক্ত হাওয়া-
তুমিও তো ফেলে আসা দিনের গন্ধমেখে ভালো করেই জানো-
ওরে ও বসন্ত জোয়ার- দুলে ওঠো, ফুলে ওঠো, সবকিছু ভুলে-
তৃষ্ণায় কাতর হলেও- চলে এসো, চাঁদের বাহার নিয়ে বৃন্দাবনী আরঙ।
নগ্ন সংলাপ
প্রাণের ভিতরে উঁকি দেয় উন্মুক্ত মিনতি।
সে আমার পদ্মাবতি নদী। গান গায় সুর তোলে আলোর খেয়ায়।
এক ছরা স্বপ্নছবি ফেলে দিয়ে আঁধারের ভোজে-
কখনো কি বাগানের কোলে ভেসে ওঠে উষ্ণতার উজ্জ্বল তোড়ন?
নাকি একদিন গিয়েছিল বেদনার হাটে।
সেখানে কি বাঁধাছিল অপেক্ষার প্রহরগোনা বিলাবলি গান!
ভোজের নামতা গুনে উচ্ছন্নে গিয়েছিল আপেল সময়-
আড়াআড়ি শুয়েছিল লজ্জাহীনা গোধুলির মাঠ।
মনের অর্গল খুলে দ্রুতপায়ে হেঁটেছিল বিচ্ছেদের অলিখিত সুর।
আমিও অভিনয়ের প্রচ্ছদ এঁকে ভোরের সন্ন্যাস সাথে নিয়ে
মধ্যাহ্ন বিকিয়েই চলি। বলি, নগ্ন সংলাপের কাছে আর কোনো ধূসরতা নেই।
ত্রিভুজিয়া ঘাট
অনন্ত সময়ের কাছে আর কোনো ধরাবাধা নেই।
লেখাজোখা: সে তো কবেই উবে গেছে তৃষ্ণার ক্যানভাস ছেড়ে।
ভুলের কপালে লাথি মেরে অন্ধ জরায়ু খুঁজেছিল
নতুনের জন্মান্তরী ছায়া। তারাও কি ভুলে গেছে আয়েশের সুস্বাদু আঁচড়।
সযতনে সময়ের হাটে হৃদয়েরা গর্বিত মিছিল করে।
পৃথিবীর ভুলোমন দেখেনা কিছুই। শুধু কি খুঁজেই চলে অসময়ের হিসেব!
কখনো কি অন্ধকারে ডুবে যাবে দিবসের বঞ্চিত পিদিম?
এতোসব ভুলের সীমানা ভেঙে
জীবনের ছোট্ট অবসরে-
মনের অজান্তে উঁকি দেয় সহজিয়ার আবেদনী গীতল।
শৌখিন সকাল রয়ে যাবে প্রতীক্ষার ত্রিভুজিয়া ঘাটে।
আলোজল
জলের ভিতর থেকে উঠে আসে মানবিক হাত।
সে যেন শতাব্দীর বন্ধ্যা গাভীর পেটের দুধের থলি।
তার পেটে আজন্ম পাপ। দুধ নাকি আলোজল এ নিয়ে লড়াই।
পৃথিবীকে কামড়ে ধরে বিড়ালের দাঁত, সুতোহীন অদৃশ্য জাল।
হাতড়ে বেড়ায় স্বপ্নের ফুসফুস মানুষের বয়সন্ধিকালে।
জীবনের পরিসমাপ্তি শুধু পালিয়ে বেড়ায় রাখালিয়া বালকের সাথে।
সে আজ মিথ্যার প্রলেপ। কেন শুধু বকে ওঠে নিজেরই সাথে!
জাগ্রত সবুজেরা বকনা বাছুর হয়ে ঠ্যাং তুলে নাচে।
রাতের পাখিরা ছড়িয়ে পড়ে বকবক করে। ভিতরে জলের ছবি।
বাহিরে জলের খেলা আর তার ছুটোছুটি রামধনু রঙ।
কে যেন ফোটার আশায় বসে আছে ছুঁড়ে ফেলা আঁকাবাঁকা পথে?
পাশের তল্লাটেই খুঁজে চলি পৃথিবীর মানবিক হাত।