সৌদির মেয়ে বোরখা ফেলে বিকিনি পরে মঞ্চে দাঁড়াবে: তসলিমা নাসরিন
সৌদি আরবকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল দেশ হিসেবেই মানুষ জানে। কিন্তু এই দেশটি সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য আধুনিকতার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। একটি অভিনব ঘটনা ঘটতে চলেছে সৌদি আরবে। যে দেশে শুধু চোখ ছাড়া মেয়েদের শরীরের সমস্ত অংশ আবৃত রাখা বাধ্যতামূলক, সে দেশে একটি মেয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, যে প্রতিযোগিতায় হিজাব বা বোরখা বা নিকাব সব ফেলে দিয়ে মেয়েদের বিকিনি পরে মঞ্চে দাঁড়াতে হবে, যে মঞ্চে শরীরের মাপজোক চলবে। ছোটখাটো প্রতিযোগিতা নয় এটি, রীতিমতো মিস ইউনিভার্স হওয়ার বিরাট প্রতিযোগিতা। হ্যাঁ, মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে এবার সৌদি আরবের পতাকা হাতে দেখা যাবে ২৭ বছর বয়সী সৌদি কন্যা রুমি আলকাহতানিকে। সৌদি আরবের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও মেয়ে মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন। আমরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলাম, আর যে দেশই অংশ নিক সুন্দরী প্রতিযোগিতায়, সৌদি আরব নেবে না। অথচ আমাদের স্তম্ভিত করে অনেক দেশই জবুথবু পড়ে আছে, আর রক্ষণশীলতার চাদর শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সৌদি আরব। রুমি আলকাহতানি তাঁর ছবি পোস্ট করেছেন সামাজিক মাধ্যমে। অত্যন্ত আঁটোসাঁটো একটি অত্যাধুনিক ড্রেস পরা মেয়ে। হিজাব নেই, বোরখা নেই।
আমি অবশ্য সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোকে আধুনিক প্রথা বলি না। শরীরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, মুখ, বুক, কোমর, নিতম্ব, আর ঊরুর মাপ দিয়ে মেয়েদের বিচার করা পৃথিবীর বড় প্রাচীন প্রথা। শরীরের এসব মাপ এককালে বাজার থেকে ক্রীতদাসী কেনার জন্য দরকার পড়তো। নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে এমন মাপের মেয়ে খুঁজতো রসিক খদ্দেররা। মেয়েদের মস্তিষ্কহীন বস্তু ভাবার জন্য সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলো বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। শরীরই যেন মেয়েদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সৌন্দর্যই যেন তাদের বাঁচার রসদ। প্রচুর নিন্দের তীর গায়ে বিঁধেছে বলে এখন প্রতিযোগিতার কর্তারা সুন্দরীদের মস্তিষ্কের অস্তিত্বও পরখ করে দেখার আয়োজন করেছে। আজকাল বুদ্ধিদীপ্ত কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয় সুন্দরীদের দিকে, মস্তিষ্ক খাটিয়ে ভালো উত্তর দিতে পারলে ভালো মার্ক্স।
সৌদি আরবের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। নিওম নামে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটা শহর গড়ে উঠছে সৌদি আরবে। নিওম হবে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার রাজধানী, সামাজিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত, ট্র্যাফিক মুক্ত, পুরোপুরি অপ্রচলিত শক্তিচালিত। নিওম ভবিষ্যৎ পৃথিবীর স্বপ্নদর্শী আর আত্মবিশ্বাসী মানুষের শহর। সৌদি আরবের প্রতিশ্রুতি, ‘নো রেস্ট্রিকশন, নো ডিভিশন, নো এক্সকিউজেস, এন্ডলেস পোটেনশিয়ালস।’ অর্থাৎ, কোনও বিধিনিষেধ নয়, কোনও বিভাজন নয়, কোনও অজুহাতও নয়। শুধু সীমাহীন সম্ভাবনার উত্তর-আধুনিক শহর হতে চলেছে নিওম। নিওমের প্রোমোশনাল ভিডিওয় হিজাববিহীন মেয়েরা স্পোর্টস ব্রা পরে শরীরচর্চা করছে, পুরুষের সঙ্গে সব রকম কাজে অংশগ্রহণ করছে। শুধু নিওম নয়, আরও অনেক অত্যাধুনিক শহর গড়ে উঠছে সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে, যেসবের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ২০৩০ সালের মধ্যে।
তাবুক প্রদেশেই লোহিত সাগর প্রকল্প শুরু হয়ে গেছে। ৫০টি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে লোহিত সাগরের তীরবর্তী সৌদির পশ্চিম উপকূলে ২৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠছে এক পর্যটনকেন্দ্র। বিমানবন্দর, বিলাসবহুল রিসোর্ট, প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা সমুদ্র উপকূল, দুর্ভেদ্য আগ্নেয়গিরি, পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য আমোদ প্রমোদের এলাহি আয়োজন। ওই পর্যটনকেন্দ্রে থাকছে না কোনও নিষেধের বেড়াজাল। গোঁড়া সৌদি সমাজে সৌদি- মেয়েদের জন্য থাকছে না কোনও নির্দিষ্ট পোশাক বিধি। মেয়েরা বিকিনি পরে সৈকতে হেঁটে বেড়াবে। অ্যালকোহল, সিনেমা, থিয়েটার কোনও কিছুতেই আর বাধা নেই। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এমনই এক অত্যাধুনিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠছে খোদ সৌদি আরবে।
বেশ কয়েক বছর আগে ফরাসি ডিস্কো জকি ডেভিড গুয়েত্তার একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল সৌদি আরবে। সেই সংগীত উৎসবে ছিল সৌদি যুবক-যুবতীদের ভিড়। ডেভিডের গানের সুরে একসঙ্গে নেচেছে তারা। প্রায়ই দেখতে পাই বিধি নিষেধের অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসছে সৌদি নর-নারী। যে দেশের আইনে অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে বাড়ির বাইরে দেখা করাটাই মেয়েদের জন্য অপরাধ, সেখানে অচেনা অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে মেয়েরা উদ্দাম নেচেছে। এ নিশ্চয়ই বিরাট এক পরিবর্তন। সৌদি আরবের অগ্রসরমানতার কৃতিত্ব যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের, এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই।
বাংলাদেশ কোনও দিনই সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশ ছিল না। কিন্তু সৌদি আরবের প্রভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি ধর্মান্ধ আর নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠছে দেশটি। সৌদি আরব বাংলাদেশি মুসলমানদের কাছে পবিত্র একটি দেশ। তারা মনে করে, সৌদি আরবের মাটি পবিত্র, জল পবিত্র, খাদ্য পবিত্র, পোশাক পবিত্র, ভাষা পবিত্র, ধর্মীয় আচার আচরণ, নিয়ম কানুন পবিত্র। পবিত্র হওয়ার কারণ ওই মাটিতে নবীজী জন্মেছেন। ওই মাটিতে নবীজী ধর্ম প্রচার করেছেন। ওই মাটিতে নবীজী চিরনিদ্রায় শায়িত। অন্যদিকে, সৌদি আরবের মুসলমানদের কাছে বাংলাদেশ হত-দরিদ্রদের দেশ। তারা মনে করে, বাংলাদেশিরা ডার্টি মিসকিন, নোংরা ভিক্ষুক। বাংলাদেশিরা সৌদি লোকদের বাসা বাড়িতে দাস দাসীর কাজ করে, অথবা রাস্তাঘাটে কল কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে। এদের নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা, শোষণ করা সৌদি আরবে কোনও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশিরা গুরুতর অপরাধ করলে জনসমক্ষে তলোয়ারের কোপে মু-ু উড়িয়ে দিতে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ দ্বিধা করে না। সৌদি আরব মনে করে না মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। সৌদি আরবের সঙ্গে বেশ কিছু মুসলিম দেশের সাপে নেউলে সম্পর্ক। বিশ্বের নামি দামি ইহুদি নাসারাদের দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। সৌদি আরব মনে না করলেও বাংলাদেশের মুসলমানরা মনে করে মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। মনে করে সৌদি আরব তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বাংলাদেশে ইসলামায়ন হওয়া, তার ওপর কট্টর সালাফি আর ওয়াহাবি মতবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে সৌদি আরবের ভূমিকা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশি মুসলমানদের বিশ্বাস আর বাস্তবতা দুটো দুরকম।
বিশ্বাস বলে সৌদি আরব বন্ধু, কিন্তু বিপদে পড়লে সৌদি আরব নয়, আশ্রয় দেয় ইহুদি নাসারারা, যাদের তারা শত্রু বলে মনে করে তারা, তাদের দেশ।
আমি ভাবছি, বাংলাদেশের যে মেয়েরা সৌদি মেয়েদের মতো কালো বোরখায় সারা শরীর ঢেকে রাখে, হাত মোজা আর পা মোজাও পরে, সৌদি আরবকে সকল দেশের সেরা দেশ বলে মনে করে, সৌদি সংস্কৃতিকে সকল সংস্কৃতির সেরা সংস্কৃতি বলে মনে করে, তারা কি দেখছে সেই দেশের পক্ষ থেকে, সেই দেশের পতাকা হাতে নিয়ে, সেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় যাওয়া রুমি আলকাহতানির পোশাক? রুমি তো তাঁর স্বদেশের পোশাককে আদর্শ পোশাক বলে ভাবছে না, তাঁর দেশের সংস্কৃতিকে আদর্শ সংস্কৃতি বলে ভাবছে না। তাঁর যে পোশাক পরতে ইচ্ছে করে, সে পোশাক সে পরেছে। সৌদি আরবের লক্ষ লক্ষ মেয়ে চায় না বোরখা পরতে, দেশের বাইরে বেরোতে গেলে পুরুষ-অভিভাবকের অনুমতি নেওয়ার যে বিধান রয়েছে-চায় না সেই বিধান মানতে, সৌদি মেয়েরা সিনেমা থিয়েটারে যেতে চায়, বারে যেতে চায়, গাড়ি চালাতে চায়, মদ্যপান করতে চায়, সংগীতানুষ্ঠানে গিয়ে পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে নাচতে চায়। পৃথিবীর যে কোনও স্বাধীনচেতা মেয়ে যা চায়, সৌদি আরবের স্বাধীনচেতা মেয়েরাও তা-ই চায়। সৌদি মেয়েদের মধ্যে ধর্ম মানে যেমন আছে, ধর্ম মানে না-ও আছে। ধর্ম মানলে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় বলে তারা মনে করে না। শুধু সৌদি মেয়েরাই নয়, বিশ্বের অনেক ধার্মিক মেয়েই মনে করে ধর্ম মানলে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় না। অনেক ধার্মিক মেয়েই মনে করে ধর্ম মানলে কোনও নির্দিষ্ট পোশাক গায়ে চড়াতে হয় না। ধর্মবিশ্বাসের কোনও পোস্টার থাকা উচিত নয়। বিশ্বাস অন্তরে থাকে, বাহিরে নয়। বাহিরে যেটি থাকে সেটি বিশ্বাস নয়, সেটি দেখনদারি। বাংলাদেশে এই দেখনদারি পোশাক এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যে, আশঙ্কা হয় এই পোশাকটি আবার সাধু সাজার পোশাক হয়ে যাচ্ছে না তো! ফেসবুকে সেদিন লক্ষ্য করলাম, নিকাবে মুখ ঢেকে মেয়েরা টাকার বিনিময় শরীর বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। পর্দার আড়ালে থেকে সমাজকে ধোঁকা দেওয়া সহজ বলেই এই পথ তারা বেছে নিয়েছে। বোরখা বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক নয়। হিজাবও বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক নয়। এগুলো যেসব দেশের পোশাক, সেসব দেশের মেয়েরা ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে এসব বাড়তি ঝামেলা। হতভাগা বাংলাদেশ। শখ করে মেয়েদের গায়ে চাপিয়ে দিচ্ছে বোঝা। কেউ আবার শখ করে বোঝাকে লুফে নিচ্ছে, এই আশায় যে এই বোরখা বা হিজাব তাকে পুলসেরাত পার করাবে, তাকে জান্নাতে নেবে। নেকি কামাই করার ধুম লেগেছে। চিত্রনায়িকা শাবানার কথাই ভাবছিলাম, নিজের সন্তানদের আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেন, আর নেকি কামাতে অন্যের সন্তানদের জন্য দেশের মাটিতে দিব্যি মাদ্রাসা বানিয়ে দিলেন। মাদ্রাসার ভবিষ্যৎ যে ভালো নয় তা শাবানা জানেন বলেই নিজের সন্তানদের কাউকেই মাদ্রাসায় পড়াননি। অন্যের ঘাড়ে চড়ে পুলসেরাত পার হওয়ার দুষ্ট ইচ্ছেগুলো ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকেরা যদি পরিত্যাগ করতেন, জাতির উপকার হতো।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা