অর্থ ও বাণিজ্য

বাংলাদেশের ব্যাংকাররা যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত

জাল ভাউচার, ব্যাংকের মূল রেজিস্টারে এন্ট্রি না করাসহ নানাভাবে মার্কিন ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করতেন সোনালী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাদের সহযোগী ছিলেন মানি এক্সচেঞ্জের মালিক-কর্মচারীরাও। যে কারণে দেশের রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এসব মুদ্রা পাচারকারীদের ধরতে প্রথমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গোয়েন্দা জাল ফেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আর এ জালেই আটকা পড়েন রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকসহ চার ব্যাংকের ১৯ কর্মকর্তা। এছাড়াও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরেও দুদকের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসী ওয়েজ আর্নার্স ও বিমানের যাত্রীরা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মূল্যবান যে রেমিট্যান্স নগদ ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসেন, তা ব্যাংকিং চ্যানেলে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তারা ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করে নিজেরাই কিনে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেন। যা পরে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আবার বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এভাবে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আসছিলেন তারা। গত ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি লিখিত অভিযোগ আসে। একইসঙ্গে দুদকের গোয়েন্দারাও সরেজমিন বিষয়টির সত্যতা পান। এরপরই গত ৫ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী কমিশনের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান চালায়। অভিযান শেষে বৈদেশিক মুদ্রার কালোবাজারিদের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও মানি এক্সচেঞ্জারদের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপরই কমিশনের অনুমোদন নিয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানে নামেন দুদক কর্মকর্তা।

বিমানবন্দরে মুদ্রা পাচার নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মুদ্রা পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়েন। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে আরও দুটি মানিএক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। বিদেশ থেকে আগত ও বিদেশে যাতায়াতকারী বিমানের যাত্রীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ ও সরবরাহ করতেন এসব কর্মকর্তা। বিমানবন্দরের সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বুথে দায়িত্ব পালনকারী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এভিয়া মানি চেঞ্জারের মো. আসাদুল হোসেন এবং ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম কবির আহমেদের সরাসরি লেনদেন হতো। তারা পরস্পর যোগসাজশে বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ব্যাংকের মূল রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতেন না। ভাউচার ও এনক্যাশমেন্ট স্লিপ সই ছাড়াই কাস্টমারকে দিতেন। অবৈধভাবে ফরেন কারেন্সি লেনদেনের বিষয়ে তাদের পরস্পর অডিও-বার্তাও সংগ্রহ করেন দুদক কর্মকর্তারা। ফরেন কারেন্সি কেনাবেচার ক্ষেত্রে এনক্যাশমেন্ট স্লিপ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও বেশিরভাগ লেনদেনেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ভঙ্গ করেছেন মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা।

দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত প্রতিদিন হাজার হাজার প্রবাসী কর্মজীবী ও বিদেশ থেকে ভ্রমণকারী যাত্রী বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন।

তারা বিদেশি মুদ্রা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জারে দেশীয় মুদ্রা বা বাংলাদেশি টাকায় এনক্যাশমেন্ট করে থাকেন। আইন, বিধি ও নিয়ম অনুযায়ী—ফরেন কারেন্সি এনক্যাশমেন্ট ভাউচার এনক্যাশমেন্টকারীকে দিতে হয়। কিন্তু ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জাররা ভাউচার না দিয়ে বা জাল ভাউচারে সরাসরি ফরেন কারেন্সি গ্রহণ করে বিনিময়ে টাকা দিয়ে দেন। এছাড়াও তারা স্বাক্ষরবিহীন, ভুয়া ভাউচার বা এনক্যাশমেন্ট স্লিপ দিতেন। এই বিদেশি মুদ্রার ক্রয়কারী ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল হিসাবে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত অ্যাকাউন্টে অন্তর্ভুক্ত করে না। ফলে কেন্দ্রীয় রিজার্ভে এসব বিদেশি মুদ্রা যুক্ত হয় না। এতে দেশে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি বা সংকট সৃষ্টি হয়। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ছাড়াও পূবালী, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। সেগুলো খতিয়ে দেখছেন তারা। দুদকের গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, এসব দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তাদের কারণে প্রতিদিন আনুমানিক একশ’ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে ব্যাংকিং খাত বঞ্চিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বুধবার (২৭ মার্চ) বলেন, ‘ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শেষে মুদ্রা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ও জড়িত অন্য ব্যাংক কর্মকর্তারাও দুদকের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। এ বিষয়ে কমিশন আইন ও বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button