শাহেদ কায়েস-এর কবিতা
কবি পরিচিতি
শাহেদ কায়েস। কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ । পৈতৃক নিবাস, সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে। পড়াশোনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই; এরপর ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে । কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে । থাকেন নিজ গ্রাম সোনারগাঁয়। পেশা ফ্রি-ল্যান্স গবেষক। তিনি একজন মুক্ত-চিন্তক, সংস্কৃতিকর্মী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৬টি । পুরস্কার ও সম্মাননা: চন্দ্রাবতী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (কবিতায়, ২০২১), শালুক সম্মাননা (২০১৯)। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ ।
শাহেদ কায়েস-এর কবিতা
প্রতিধ্বনি
গভীরে খুরের আওয়াজ, হ্রেষাধ্বনি, তারপর শুধু গতি
আর গতি… দিগভ্রান্ত পথ, পায়ে পায়ে হাওয়ার রাজ্য
যেভাবে একটি জীবন নিভৃতে শাসিত, কুঠারে সবুজেরা…
‘বৃক্ষ বেজে ওঠে যার আঘাতে আঘাতে, সে কি প্রতিধ্বনি!’
প্রাচ্যের রহস্য নগরী, ইটের লবণ বিলাস— দোল পূর্ণিমার রাত
জোড়বাংলা স্থাপত্যের তীব্র হাস্নাহেনা, সংস্কারে রেখেছ হাত!
দুলে ওঠে তোমার প্রাচীন বন, মন্দিরে কি থাকে তখন?
হ্রেষাধ্বনি, গতি, এক ঝলক হাওয়া— অজন্তা-ইলোরা, আহা
নক্ষত্র-জোনাকপোকা-শস্যঢেউ, ফাল্গুনের মাতোয়ারা চাঁদ!
শূন্যতা
নির্বাক কবরস্থানে জোনাক-জ্বলা সন্ধ্যায়—
ফেলে এসেছি আমার শৈশব; পাশেই শীর্ণ
ব্রহ্মপুত্র নদ— শুনি জলের অধরা বিস্মৃতি
আমাকে জানে ওই শতবর্ষী বট, যে দুঃখ না—
পাওয়ার দুঃখে ঝুঁকে থাকে ব্রহ্মপুত্রের জলে
কুমারীপথ, শৈল্পিক বাঁক, ট্রেনের হুইসেল
গেল কি বিশ্রামে— বটগাছটির আড়ালে?
দল বেঁধে শূন্যতা ঝাঁপ দেয় নবীন কবরে
সারারাত গোর-খোদকদের আলাপ শুনি
সেই জোনাকিদের কোথাও দেখিনা আর।
প্রকৃতি গণিত
জঙ্গলে ঝাঁকে-ঝাঁকে নেমেছে আলো
অপরূপ জ্যামিতিক নকশায়…
বাঁশঝাড় ছুঁয়েছে বিষাদ, বিগত রাতের
ফুটি তুলো উড়ছে ভোরের আকাশে
বেগুনী রঙের জামদানি বাতাসে―
চোখ জুড়ানো বুনন ও সৌন্দর্য…
বৃক্ষের পুস্তকে রেখেছি তৃষ্ণার্ত চোখ
এ কোন ভাষায় কথা বলছে প্রকৃতি!
এই স্থির, এই অস্থির রাজ্যে এসে বুঝি
প্রকৃতির গণিতে আমরা সবাই সংখ্যা―
জগতের প্রতিটি প্রাণ, এমনকি মানুষও।
গণিতের চেয়ে সংখ্যা বড় হয়ে উঠতে নেই।
সম্পর্ক
চিরস্থির কেন্দ্র বলে কিছুই নেই
কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে…
একেকটি সম্পর্ক কেন্দ্রের মতো
পরিধি ঘিরে এতো-এতো আয়োজন!
যদিও প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন আমি…
জন্ম নেয়া নতুন আমি— পুরনো আমি
দুই আমির মাঝে বয়ে চলে এক নদী
ঠিক তেমনি, তুমিও— প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন
আমির সঙ্গে তুমি, তুমির সঙ্গে সে
এভাবেই সম্পর্কগুলো ছড়িয়ে পড়ে…
উড়ে গেলেও প’ড়ে রয় সম্পর্কের পালক
এ-ঘরে, ও-ঘরে পায়চারি করে—
তোমার ফেলে যাওয়া স্পর্শ
কোনো সম্পর্ক চিরতরে হারিয়ে যায় না
ফিরে ফিরে আসে— তুমি, আমি, সে…
যেমন পৃথিবীর জল মেঘ হয়ে ওড়ে—
ভাসতে-ভাসতে একদিন বৃষ্টি হয়ে ফেরে।
হারানো সম্পর্ক যদিও আগের মতো—
থাকে না— ফিরে আসে নতুন মাত্রায়…
আমরা কেউই কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নই।
বাঘ
বছর জুড়ে একটি বাঘ সারাক্ষণ পাহারা—
দিচ্ছে, শাসন করছে, চোখে-চোখে রাখছে।
প্রতিমুহূর্তে নজরদারিতে তোমার জীবন…
বার্তা নিয়ে এলো— পূব-পশ্চিমের হাওয়া;
নিজের ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে যে
শরৎ বুঝি জীবনকে বিষমুক্ত করার ঋতু!
কী অসীম মায়ায় জড়িয়ে রাখো কাঁচা হলুদ
নিম পাতার রস! খুঁজি আমি বাঘমুক্তি পথ
শরৎ এসেই পালিয়ে যাওয়ার উস্কানি দেয়
আমিও চাই— বিষমুক্ত হই, একটু জিরাই।
বাস্তুসাপ
সাগরে ভাসছে অসংখ্য বেওয়ারিশ নিঃশ্বাস
মানুষগুলো তখন গভীর সমুদ্রে ক্ষুধার জ্বালায়
পাগল হয়ে ঝাপ দিচ্ছে মৃত্যু-দরিয়ায়…
তীব্র যন্ত্রণায় আলিঙ্গন করছে অস্থির নিঃশ্বাস
ছুঁড়ে ফেলছে মুর্দা নোনা-জলে, বন্ধু-স্বজনেরা
প্রতিশ্রুতির বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে—
সেই যে গেলে! বাইরে রাত শিকড় ছড়ালো
অন্ধকারে… অপূর্ব সুন্দর এক ফণা তুলে
দুলছে তীব্র প্রতিশ্রুতি লতা—
মানুষ মুগ্ধ বিষাক্ত সৌন্দর্যে, যদিও বিষধর—
আহা! কি রূপ! এ যে বাস্তুসাপ, মারতে নেই!
প্রেম
প্রেমে আক্রান্ত মানুষ প্রতিধ্বনি হয়ে যায়, চতুর্দিকে
ছড়িয়ে পড়ে প্রতিধ্বনি— গাঙের ঢেউয়ে, অরণ্যে
সমুদ্র, পাহাড় সব একাকার করে তোলে প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনির কাছে আমি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করি
ফিরিয়ে দাও দরোজা-জানালা-দেয়ালহীন একটা
জীবন— প্রাণপ্রকৃতির দোলায় দেহহীন নিঃশ্বাস
উৎসের কাছে কেন যে বারবার ফিরে আসো তুমি!
প্রেম মানেই আংশিক মৃত্যু, আংশিক নতুন জন্ম