ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক একটি উগ্রজাতীয়বাদী স্লোগান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটিকে ফ্যাস্টিট স্লোগানই বলা যায়। বিশ্বায়নের এই যুগে কোন একটি পণ্য কোন বিশেষ দেশের নয়। বরং সবগুলো পণ্যই বহুজাতিক। সেই অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট দেশের পণ্যকে টার্গেট করে তাদের নিষিদ্ধ করার ঘোষণা উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং কুৎসিত রাজনীতির একটি বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু রাজনীতির এই তাত্ত্বিক আলোচনা বাদ দিলে বাস্তবতা নিরিখে যদি আমরা বিচার করি, তাহলে দেখব ভারতীয় পণ্য ছাড়া কি বাংলাদেশ চলবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা নির্মোহভাবে যদি বিচার করি, তাহলে দেখব যে, বাংলাদেশের অনেক কিছুই ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
পেঁয়াজের কথাই ধরা যাক, কদিন আগে ভারত সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা দিয়েছে। সাথে সাথে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরতা থাকবেই। বিশ্বের সবগুলো দেশই তাদের প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও তার প্রতিবেশীর ওপর নির্ভর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো ভারত একটি বিরাট প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং ভারতের ওপর সারাবিশ্বই নানাভাবে নির্ভরশীল। সেখানে এরকম একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের পণ্য বর্জন করে বাংলাদেশ কতটুকু চলতে পারবে- সেটি দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ নানাক্ষেত্রে ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে থাকে। আমরা যদি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কথাই বলি তাহলে পেঁয়াজ, চাল, আদা রসুনসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা যেমন জিরা, গরম মসলা ইত্যাদির জন্য আমরা অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত থেকে যদি এই সমস্ত পণ্য সরবরাহ না করা হয় তাহলে আমাদের বাজারে এক বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে, অস্থিরতা তৈরি হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও আমাদের পরিধেয় এবং ফ্যাশনের অনেক কিছুর জন্যই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। শাড়ি থেকে শুরু করে থ্রি-পিচ, সালোয়ার কামিজ, ছেলেদের জন্য নানা ধরনের পাঞ্জাবি এবং নানা রকমের পোষাকের জন্য আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এ সমস্ত পণ্য যদি বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়ে যায়, সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করবে।
বিনোদন জগতে আমরা পুরোপুরিভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে এরকম খুব কম পরিবার আছে- যারা ভারতীয় ছবি দেখেন না, ভারতীয় গান শোনেন না বা ভারতীয় চ্যানেলগুলো দেখেন না। তাই ভারতীয় পণ্য বর্জন বাংলাদেশের বাস্তবতায় একেবাবে অসম্ভব। এই স্লোগানটি আসলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের জন্য নয়। এটি একটি উগ্রসাম্প্রদায়িক স্লোগান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, যখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে, তখন এর পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টি করা হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, সংখ্যালঘুদের অত্যাচার, নিপীড়ন করা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে এখন নতুন করে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের আড়ালে বাংলাদেশেকে আবার একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর পায়তাঁরা করছে। যে চেষ্টা পঁচাত্তরের পর শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নষ্ট করে এটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে দেখিয়ে ভারতকে চাপ দেওয়ার যে কৌশল সে কৌশলটি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।