নামাজ-রোজা (Roja) নিয়ে আমাদের বাড়িতে কোনও জোর জবরদস্তি ছিল না। মা রাতে ঘুমোবার আগেই বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞেস করতেন, কে কে রোজা রাখবে কাল? যারা রাখবে, তারা বলে দিত রাখবে, যারা রাখবে না তারা বলে দিত রাখবে না। মা শুধু তাদেরকেই শেষ রাত্তিরে খেতে ডাকতেন, যারা রোজা রাখতে চেয়েছে। আর যারা রাখতে চায়নি, তারা বেঘোরে ঘুমোত। ওদের ঘুম যেন না ভাঙে, সেহরি খাওয়া মানুষগুলো সেদিকে খেয়াল রাখত, আওয়াজ করত না বেশি।
নামাজের বেলাতেও একই নিয়ম ছিল। যার ইচ্ছে নামাজ পড়ত, যার ইচ্ছে নেই, পড়ত না। এ কারণে কেউ কাউকে ভর্ৎসনা করত না। নামাজ পড়তে ইচ্ছুকেরা নামাজ-না-পড়তে ইচ্ছুকদের কাউকে জোর করে নামাজে দাঁড় করাতো না। আর নামাজ না পড়তে যারা ইচ্ছুক ছিল, তারা নামাজে দাঁড়ানো কাউকে জায়নামাজ থেকে টেনে সরাতো না। আমাদের বাড়ির এই নিয়মগুলো লিখিত বা মৌখিক কোনওটিই ছিল না। অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মের মতো। যার খিদে পেয়েছে, সে খাবে, যার তেষ্টা পেয়েছে, সে পান করবে, যার ঘুম পেয়েছে, সে ঘুমোবে, যার পড়তে ইচ্ছে করছে, সে পড়বে।
যার ইচ্ছে নামাজ পড়ত, যার ইচ্ছে নেই, পড়ত না। এ কারণে কেউ কাউকে ভর্ৎসনা করত না। নামাজ পড়তে ইচ্ছুকেরা নামাজ-না-পড়তে ইচ্ছুকদের কাউকে জোর করে নামাজে দাঁড় করাতো না। আর নামাজ না পড়তে যারা ইচ্ছুক ছিল, তারা নামাজে দাঁড়ানো কাউকে জায়নামাজ থেকে টেনে সরাতো না।
ইফতারের সময় মা সবাইকে খেতে ডাকতেন। সবাই খাবার টেবিলে বসে যেতাম, মা সবাইকে সমান আদরে বেড়ে দিতেন ইফতারি। রোজা রাখা আর না-রাখাদের থালায় একই রকম খাবার থাকত। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, আমাদের বাড়িটা আসলেই আদর্শ বাড়ি ছিল।
আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদের আজান শোনা যেত না। ষাট-সত্তর দশকে এমনকী আশির দশকেও দেশে অত মসজিদ ছিল না। কিন্তু বাড়িতে যারা নামাজ পড়ত, তাদের নামাজের সময় নিয়ে কখনও কোনও অসুবিধে হত না। বাড়িতে দেওয়াল ঘড়ি ছিল। মা তো উঠোনের রোদ দেখেও বলে দিতে পারতেন, নামাজের সময় হয়েছে কি না।
কোরানে পড়েছি, লা ইক্রাহা ফিদ্দিন, ধর্মে কোনও জোর জবরদস্তি নেই। আমার মনে হয়, কোরানের সবচেয়ে মূল্যবান আয়াত এটিই। এই আয়াতকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করলেই শান্তির পৃথিবী তৈরি করা যায়। ইসলামের পণ্ডিতরা এই আয়াতটির ব্যাখ্যা এইভাবে দেন — ‘ইসলামের সঙ্গে জোরজবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, নিপীড়ন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রভৃতির কোনওই সম্পর্ক নেই। এসব ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড। কেননা দীন বা ধর্ম নির্ভর করে বিশ্বাস ও আন্তরিক ইচ্ছার ওপর। বলপ্রয়োগ করে কাউকে প্ররোচিত করা বা রাজি করানো ইসলাম সমর্থন করে না। ফিত্না-ফাসাদ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি সৃষ্টি করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলামে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’
প্রশ্ন হলো ক’জন মুসলমান মেনে চলেন এই ব্যাখ্যা?
আমি বুঝি না, কোরানে যা লেখা আছে বলে মুসলমানরা গৌরব করে, সেটির চর্চা কেন তারা করে না? ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই, আল্লাহ বলেছেন। আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর উপদেশ মেনে চলবে, এ তো সকলেই আশা করে। অথচ কী হচ্ছে? সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন এক আইন করেছে, কেউ যদি রমজান মাসে বাড়ির বাইরে কিছু খায়, বা পান করে, তাকে প্রচুর টাকা জরিমানা দিতে হবে এবং এক মাস জেল খাটতে হবে। বাংলাদেশে খাবার দোকানগুলোকেও দিনের বেলায় খুলতে দেওয়া হয় না। যদি কেউ খোলেও, রোজাদাররা লাঠিসোটা নিয়ে সেই দোকান ভাঙচুর করে। পিপাসার্ত অমুসলমানদের অধিকার নেই এই প্রচণ্ড গরমে কোথাও বসে এক আঁজলা পানি পান করার? কেউ সামান্য পানি পান করতে গেলেই জোরজবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, নিপীড়ন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চলছে।
অরোজাদাররা রোজাদারদের ভয়ে অতিষ্ট। রোজাদারদের অনেকে মনে করেন, কেউ তাদের সামনে কিছু খেলে বা পান করলে তাদের অসম্মান করা হয়। আমি তো আমার রোজাদার মা’র সামনে পেট পুরে খেতাম, খেয়ে স্বস্তি হয়েছে বলে মা’র ভালো লাগত। আমাকে কত দিন মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন মা। মা’র তো কখনও মনে হয়নি, আমি মাকে অসম্মান করছি! আমারও তো কখনও মনে হয়নি, আমি রোজা (Roja) রাখিনি বলে মা আমাকে কিছু কম ভালোবাসছেন। মা খুব সৎ এবং নিষ্ঠ ধার্মিক ছিলেন, রোজা রাখার এবং না-রাখার স্বাধীনতাকে মূল্য দিতেন। আজকালকার ধার্মিকদের মধ্যে এই গুণটির প্রচণ্ড অভাব। অসহিষ্ণুতা আর অরাজকতাকে তারা ধর্মের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করছে।
হাশরের ময়দানে রোজাদাররা আল্লাহর সুনজরে পড়বেন। এ কি যথেষ্ট নয়? রোজাদাররা কেন অরোজাদার এবং অমুসলমানদের কাছ থেকে সম্মান পেতে চান? আর অরোজাদারদের দিকটাই বা দেখি না কেন, নিজেদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হলেও কেন সম্মান দেখাতে হবে রোজাদারদের? সম্মান তো, যতদূর জানি, পারস্পরিক। তুমি আমাকে সম্মান দিলে আমি তোমাকে সম্মান দেব। তাই নয় কি? সম্মান কি এতই ঠুনকো, যে, কাউকে খেতে দেখলে বা পান করতে দেখলে ভেঙে যায়? মা বলতেন, কেউ সামনে খাচ্ছে বা পান করছে, দেখেও যদি তুমি নিজের খাওয়া বা পান করার ইচ্ছে সংবরণ করতে পারো, তাহলে তোমার রোজা আরও পোক্ত হবে। এভাবে কি আজকাল কেউ আর ভাবে না?
বাংলাদেশে শেষ রাত থেকে শুরু হয়ে যায় মানুষের ঘুম ভাঙাবার জন্য বিকট ডাকাডাকি। সেই চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে যায়। যারা সেহরি খেতে উঠতে চায় না, তাদেরও ঘুম ভেঙে যায়। তাদের কি অধিকার নেই ঘুমোবার? একই কথা বলা যায় আজানের ব্যাপারে। একসময় যখন মানুষের অ্যালার্ম ঘড়ি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, তখন সেহরি খেতে ওঠার জন্য পাড়ার ছেলেদের চিৎকার হয়তো সেহরি যারা খেতে চায়, তাদের উপকার করত। এখন এই টেকনোলজির যুগে চিৎকার চেঁচামেচি সম্পূর্ণই অর্থহীন। মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম কী করে সেট করতে হয়, তা, আমার বিশ্বাস, সবাই জানে। না জানলেও এটি শিখে নেওয়া দু’মিনিটের কাজ। (Roja)
যারা রোজা রাখতে চায় তাদের অধিকার আছে রোজা রাখার। যারা রোজা রাখতে চায় না, তাদেরও অধিকার থাকা উচিত রোজা না রাখার। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে ধার্মিক হওয়ার, অধিকার আছে ধার্মিক না হওয়ার। সারা পৃথিবীতেই দেখি ধর্মকর্ম করার সবরকম অধিকার মানুষের আছে। শুধু তাই নয়, ধর্মে যাদের অবিশ্বাস, তাদের নিন্দে করার অধিকারও ধার্মিকদের আছে। কিন্তু অবিশ্বাসীদের কোনও অধিকার নেই ধর্মবিশ্বাসীদের নিন্দে করার। নিন্দে করলে অপদস্থ হতে হয়, মামলায় ফাঁসতে হয়, জেল খাটতে হয়, নির্বাসনে যেতে হয়, খুন হয়ে যেতে হয়।
ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যার ধর্ম পালন করতে ইচ্ছে করে, সে করবে পালন। যার পালন করার ইচ্ছে নেই, সে করবে না। যার পালন করার ইচ্ছে নেই, তাকে কেন রাষ্ট্র বা রাজ্য বা সমাজ জোর করবে, বাধ্য করবে ধর্ম পালন করতে? ধর্ম কি তবে মুক্তির কোনও উপায় বলবে না, পরাধীনতার শেকলই কেবল পরাবে? রাষ্ট্র কিন্তু সবার জন্য। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য নয়, সংখ্যালঘুদের জন্যও। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু— সবাইকে সমান চোখে দেখা সরকারের দায়িত্ব।
চিনের সরকার চিনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে রোজা নিষিদ্ধ করেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, কর্মী ও শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কারও বেলায় অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। স্বাস্থ্যের কারণে শিক্ষার্থীদের রোজা রাখা ঠিক নয় বুঝি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কমিউনিজমে এবং নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হওয়ার শর্ত যেহেতু আছে, তাদেরও রোজা রাখাটা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলে তো নাস্তিক নয়। তারা যদি রোজা রাখতে চায়, তবে রোজা রাখতে তাদের কেন বাধা দেওয়া হবে? সরকার নিশ্চয়ই বোঝাতে চায়, রোজা রাখলে যেহেতু শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করে, দিনের বেলায় অফিসের সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু যারা রোজা রেখেও দিব্যি ক্লান্তিহীন কাজ করে যেতে পারে, তাদের রোজা রাখার অধিকার কেন থাকবে না? সব রোজাদার তো অফিসে বসে ঝিমোয় না! চিনের সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার নিন্দে করেছি আমি।
গণতন্ত্রবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য চিনকে বিশ্বের লোক নিন্দে করে। মুসলিমদের রোজা রাখার অধিকার হরণ করার কারণেও নিন্দে করে। চিন অবশ্য বলে দিয়েছে, মুসলিম জঙ্গি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেই মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোয় রোজার সময় কড়া নজর রাখে চিন-সরকার। রমজান মাসে ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ না রাখার সিদ্ধান্তটি আমি মনে করি, ঠিক।
রোজা নিয়ে চিন যা করছে তার ঠিক উল্টোটা করছে মুসলিম দেশগুলো। রোজা না রাখলে বাইরে কিছু খাওয়া, বা কিছু পান করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করছে।
ইসলাম যদি আরও উদার না হয়, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি মুসলমানের। আজ বিশ্বের অগুনতি মানুষ মুসলমানদের নিন্দে করছে। অনেকে তাদের আর বিশ্বাস করছে না। মুসলমান নাম শুনেই ছিটকে সরে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে। মুসলমানরা দুনিয়া জুড়ে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে অসহিষ্ণু, ঘাতক, বর্বর বলে চিহ্নিত হচ্ছে। ইসলামকে উদার করার দায়িত্ব নিতে হবে মুসলমানকেই। বিশ্বের কাছে মুসলমানদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা সন্ত্রাসী আর অসহিষ্ণু নয়। তারা মুসলমান-জঙ্গিদের সমর্থন করে না। তারা ক্ষমায়, উদারতায়, স্বাধীনতায় এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে। তারা মানুষের মত-প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে। মানবাধিকার আর গণতন্ত্রকে সম্মান না করলে বিশ্বের বিবেকবান মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার কোনও পথ খোলা নেই।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম না হয়েও নামাজ পড়েন, রোজা করেন। যদিও আমরা সবাই বুঝতে পারি এসব তিনি মন থেকে করেন না, মুসলিমদের ভোট পাওয়ার জন্য করেন। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি না তার নামাজ রোজায় কারও বাধা দেওয়া উচিত। তাঁর অধিকার আছে যে কোনও ধর্ম পালনের। একসঙ্গে একাধিক ধর্ম পালনের অধিকার কে বলেছে কারও নেই? কোনও ধর্ম পালন না করার অধিকার যেমন মানুষের আছে, এক বা একাধিক ধর্ম পালনের অধিকারও মানুষের আছে। তবে একটি কথা কেউ যেন ভুলে না যায় যে, রাষ্ট্রের চোখে ধর্ম পালন যে করছে এবং যে করছে না– দু’জনের গুরুত্বই সমান, দু’ব্যক্তির অধিকারই সমান।
তসলিমা নাসরিন
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। ‘নির্বাচিত কলাম’ ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু’দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন ‘ফেরা’, ‘লজ্জা’, ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।