দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন ঘিরে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঘটছে নতুন মেরূকরণ। এলাকায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছেন নতুন সংসদ সদস্যরা। বিপরীতে ভবিষ্যৎ বিবেচনায় শক্তিশালী বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন সংসদ নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা। ফলে দলীয় প্রতীক না থাকলেও উপজেলার ভোটে থাকছে নৌকা বনাম স্বতন্ত্রের ছায়া। সেইসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে জেলার শীর্ষ নেতারাও পছন্দের প্রার্থীকে সামনে রেখে তৎপর রয়েছেন। এ ছাড়া মাঠ উন্মুক্ত হওয়ায় প্রার্থী হচ্ছেন জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এর আগে কখনোই একটি উপজেলায় ভোটের লড়াইয়ে একসঙ্গে আওয়ামী লীগের এত নেতা মুখোমুখি দাঁড়াননি। ফলে এই ভোটের পর দলীয় বিভক্তি কতটা তীব্র হবে—তা ভেবে উদ্বিগ্ন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা। এর মধ্যে দলের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে জিতেছেন ৬২ জন। তাদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরা এখন মাঠপর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর প্রথম ধাপ হিসেবে উপজেলা নির্বাচনকেই বেছে নিচ্ছেন তারা।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী যেসব নেতা জাতীয় নির্বাচনে হেরেছেন, তারাও এলাকার আধিপত্য ছাড়তে চাইছেন না। উপজেলা নির্বাচনে নিজ বলয়ের প্রার্থীকে জিতিয়ে সেই অবস্থান ধরে রাখতে চাইছেন তারা। এ কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এই নির্বাচন কেন্দ্র এসব এলাকার রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ তৈরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের মতোই এবারের উপজেলা নির্বাচন উৎসবমুখর হবে। দল যেহেতু প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু আশা করব কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতারা সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করবেন। কোনোভাবেই যাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকবেন তারা। বিশৃঙ্খলা করলে কেউ রেহাই পাবে না।’
সূত্রগুলো জানায়, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, বরগুনা, বরিশাল, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামসহ অন্তত ৪০টিরও বেশি জেলায় জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনীতির নতুন মেরূকরণ চলছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল এবং সিলেট বিভাগের কোনো কোনো উপজেলায় পাঁচ থেকে সাতজন প্রার্থীও চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমেছেন। ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার উপজেলাগুলোতেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। সিলেটের বিশ্বনাথ ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কমপক্ষে হাফ ডজন নেতা প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একইভাবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে ছয়জন নেতা এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় কমপক্ষে পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মধ্যে কেউ বর্তমান এমপি, কেউ সাবেক এমপি বা মন্ত্রী এবং কেউ কেউ জেলার শীর্ষ নেতাদরে আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে মাঠে নেমেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও চাইছেন কোনো না কোনো মন্ত্রী-এমপি অথবা প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ সমর্থনে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার। প্রতীক না থাকায় সিংহভাগ প্রার্থীই দলের ‘মৌন সমর্থন’ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ বি এম আনিসুজ্জামানের স্ত্রী শামীমা বেগম। আনিসুজ্জামান আগে পৌরসভার মেয়র ছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি পদত্যাগ করলেও এমপি হওয়ার পর নিজের স্ত্রীকে পৌর মেয়র বানাতে মাঠে নামেন। এমনকি আচরণবিধি ভঙ্গ করে ভোটও চান। এ নিয়ে প্রতিপক্ষ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়।
অন্যদিকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা। তার জন্য নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন এমপি বাহার।
একইভাবে প্রতিটি জেলায় উপজেলা নির্বাচনের অনেক প্রার্থী নানাভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর সমর্থনের আশায় ধরনা দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি সংসদ নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট দলীয় দ্বন্দ্ব-কোন্দল কমানোসহ সংঘাত-সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে উপজেলায় দলীয় প্রতীক না দেওয়ার কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। গত ২৩ জানুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দলীয় এই কৌশল তৃণমূল পর্যায়ে পুরোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত উসকে দিচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে দলের এ কৌশলের কারণে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে দলেরই আরেক নেতাকে তুলে নিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা জানান, এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হবে না। সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য। নির্বাচন কমিশনও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ভোটারের স্বাক্ষরের শর্ত শিথিল করে নির্বাচনে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন। কিন্তু নির্দলীয় এ নির্বাচনও দলীয় রূপ দিতে তৎপর স্থানীয় এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা। তাদের অনেকেই নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বলে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ দলীয় প্রতীক না থাকায় শেষ পর্যন্ত দলের মৌন সমর্থন পাবেন, এমন আশা নিয়েও প্রার্থিতা ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন। কেউ আবার নিজের প্রার্থীকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করে আনার জন্য নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। তবে এটি কোনোভাবেই গ্রহণ করছেন না প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা।
জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় নতুন সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসান পলাশ বলেন, ‘প্রার্থীদের মধ্যে যিনি শ্রম ও মেধা দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবেন এবং যার অবস্থান ভালো থাকবে, তার হয়ে আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। এক্ষেত্রে কাউকে সমর্থন না দেওয়া দলের নীতিকেই অনুসরণ করব। তবে যারা এর আগে জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছেন, তাদের দিক থেকে সাধারণ ভোটাররাই মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’
এদিকে স্থানীয় পর্যায়ের দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও মেরূকরণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণের প্রস্তুতিও চলছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। দলের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কোনো সংঘাত যাতে না হয়, সে জন্য ঈদের পর পরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক করা হবে। সেই বৈঠক থেকে দলের সব প্রার্থীর জন্য কিছু নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দ্বন্দ্ব-কোন্দল এড়ানোর পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘দলের শৃঙ্খলা যেন ভঙ্গ না হয় সে বিষয়ে আামরা কঠোর অবস্থানে আছি। নির্বাচনে অংশগ্রহণের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে—তা হতে দেওয়া হবে না।’