৩৩ ধরনের নিপীড়ন চলতো পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন সেলে
পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে তার বর্ণনা এ প্রজন্মের জানা জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা। দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় আটটি নির্যাতন কেন্দ্র শনাক্ত করে সেখানে নির্যাতনের যে ধরনগুলো উঠে আসে, তার ভয়াবহতায় শিউরে উঠতে হয়।
তারা বলছেন, এর বাইরেও নির্যাতনের নানা ধরনের খবর পাওয়া যায় বেঁচে ফেরা মানুষদের মুখে। এর প্রচুর বিবরণ থাকা উচিত ছিল, যাতে ভবিষ্যতে নাগরিকরা বুঝতে পারে বাংলাদেশবিরোধীরা কী রকম প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল।
মুনতাসির মামুন ২০১৯ সালে ড. এ আর মল্লিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড উদ্বোধনী বক্তৃতায় গণহত্যার রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে সেই বক্তব্যটি বুকলেট হিসেবে প্রকাশ করে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। সেখানে তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলার জরিপ ও বিবরণীতে কিছু নির্যাতনের ধরন উঠে এসেছে। জরিপের বিবরণী থেকে মোটাদাগে ৩৩ রকমের নির্যাতনকে আলাদা করা যায়।
একাত্তরে নির্যাতন সেলের নিপীড়নের ধরন:
বেশিরভাগ সেলেই হাত-পা বেঁধে, পা ওপরের দিকে তুলে ঝুলিয়ে রাখা ছিল একটি ‘সাধারণ’ নির্যাতন। খুলনা সার্কিট হাউজ, বিভিন্ন বধ্যভূমিতে গাছের সঙ্গে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হতো, যাতে পথচারীরা তা দেখতে পায়। এসব নির্যাতন সেলে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো, চাকু বা ব্লেড দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটা হতো। এমনকি হাত-পা বেঁধে রান্নার বড় পাতিলের মধ্যে করে পানির হাউজে নিক্ষেপ করা হতো। নাটোরের নির্যাতন সেলে এমন ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়।
কিছু কিছু নির্যাতন সেলে বিকৃত চিত্রও পাওয়া গেছে। নাটোরের নির্যাতন সেলেই অন্য কারও যৌনাঙ্গে মুখ ঘষে নির্যাতন চালানো হতো। নারীদের বিবস্ত্র করে ফ্যানের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। সেলগুলোতে পুরুষ ও নারীদের বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করতো। সাতক্ষীরার নির্যাতন সেলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জুটমিলের বয়লারে আগে মাথা ঢুকিয়ে, পরে পুরো শরীর ঢুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা পাওয়া গেছে। খুলনা ও সৈয়দপুরে এমন ভয়াবহ নির্যাতনের খোঁজ মিলেছে। এছাড়া খুলনায় হাত-পা বেঁধে জীবিত মানুষকে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলা কিংবা কুড়াল দিয়ে বুক চিরে কলিজা বের করার মতো নৃশংস ঘটনার খোঁজ পাওয়া গেছে।
কোথাও ব্লেড বা ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে লবণ ও মরিচের গুঁড়ো মাখিয়ে দেওয়া, পানি চাইলে মুখে প্রস্রাব ঢেলে দেওয়া, শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রক্ত না বেরোনো পর্যন্ত অশ্রাব্য গালিগালাজ করা, সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছ্যাঁকা দেওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। বিশেষ করে কুমিল্লার লাকসামে বন্দি নারীদের ওপর এমন নির্যাতন চালানো হতো। হাত পায়ের নখে সুচ ঢুকিয়ে দেওয়া এবং হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলার মতো বর্বরতাও চালানো হতো।
দড়িতে পা বেঁধে ঝুলিয়ে গরম পানিতে বারবার ডোবানো, সূর্যের দিকে মুখ করে শুইয়ে রাখাও হতো। আবার মলদ্বারে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নারীদের স্তন বা যোনি কেটে ফেলা কিংবা পুরুষদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলেও নির্যাতন চালিয়েছে পাকবাহিনী। কোথাও গাড়ির পেছনে বেঁধে গাড়ি চালানোর তথ্যও পাওয়া গেছে। নীলফামারীতে পাট বেলিং প্রেসারের নিচে রেখে দিয়েও নির্যাতন চালানো হতো। আবার কখনও কখনও কাঁচা বাঁশের মধ্যে রেখে শরীর থেঁতলে দেওয়া হতো। এছাড়া খেজুর বা বরইয়ের কাঁটা রেখে তার ওপর গড়াগড়ি দিতে বাধ্য করা, পিচঢালা রাস্তায় সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখাও হতো।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলি অঞ্চলে নির্যাতনের চিত্রে উঠে এসেছে। সেখানে বন্দিদের গলা কেটে ফেলা হতো। এছাড়া মাটির মধ্যে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা, বিষ পিঁপড়া শরীরে লেলিয়ে দেওয়ার (বেলতলি গণহত্যা) ঘটনাও ঘটেছে।
আবার দড়ি দিয়ে বেঁধে নৌকা বা লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে টেনে নেওয়া, নগ্ন করে বরফের স্লাবে শুইয়ে রাখা, অন্ধকার ঘরে ২৪ ঘণ্টা আলো জ্বেলে রাখা এবং চোখে এসিড ঢেলে দেওয়ার (নাটোর) তথ্য পাওয়া গেছে।
মুনতাসির মামুন তার বক্তৃতায় বলেছেন, এগুলো কিছু উদাহরণ মাত্র। আরও কত রকমের অত্যাচার করা হতো তা বর্ণনা করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিভিন্ন বই পড়লে।
আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও ব্যাপকভাবে তুলে ধরা জরুরি কেন এবং করণীয় কী জানতে চাইলে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতনের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে ধরতে হবে। বিশ্বে যত জেনোসাইড হয়েছে, প্রতিটির ক্ষেত্রে প্রজন্ম পর প্রজন্ম ইতিহাসটাকে ধরে রাখার চেষ্টা দেখা গেছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা কাজের সঙ্গে আগ্রহী তরুণদের ব্যাপক হারে যুক্ত করা দরকার। বিশেষত যার যার এলাকার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন সাইট শনাক্ত করা এবং সংরক্ষণ করার কাজে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তরুণদের যুক্ত করতে হবে। সঠিক তথ্য ও ইতিহাসের উপাদান নিশ্চিত করতে ওয়াকিবহাল ও যোগ্য একটি টিমের ছায়াতলে সার্বিক কাজ বাস্তবায়ন করা জরুরি।’
মুনতাসির মামুন তার বক্তৃতায় করণীয় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, তার প্রচুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করা উচিত, যাতে তরুণ প্রজন্ম বুঝতে পারে কীভাবে পাকিস্তানবিরোধীরা অত্যাচার করেছিল। এবং তারা যেন প্রশ্ন তুলতে পারে, যারা এসব ঘটিয়েছে এবং যারা এদের সমর্থন করে বাংলাদেশে তাদের রাজনীতির অধিকার থাকতে পারে কিনা?