বিএনপির প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। দলটির এই অবস্থানের সঙ্গে মালদ্বীপে ভারতবিরোধী তৎপরতার মিল দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি হতাশা থেকে এ ধরনের অবস্থান নিয়েছে। তবে এতে বিএনপির উদ্দেশ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিএনপিবাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “বিএনপি যে নতুন কর্মসূচি শুরু করেছে তা হলো ভারতের পণ্য বর্জন। এ রকম মালদ্বীপে হয়েছিল। সেটি ছিল ‘ইন্ডিয়া আউট’ (ভারত খেদাও) কর্মসূচি। আমার মনে হয়, ওটারই একটা প্রভাব এখানে দেখতে পাচ্ছি।
তবে এটি এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মধ্যে না আনাই ভালো।”
বিএনপি নেতারা ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে সমর্থন দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তাঁদের ভাষায় বাংলাদেশের জন-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থানের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় আসবে না আসবে এটি বাংলাদেশের জনগণের বিষয়।
ভারত কখনো বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু আমেরিকানরাও বলছে, তারা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। নির্বাচনের ফল ও বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছে।’
বীণা সিক্রি বলেন, ‘আমি জানি না কিভাবে একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে পরে আবার ভারতকে দোষারোপ করতে পারে? ভারতকে দোষারোপ করে কর্মসূচি দেওয়ার কারণ হতে পারে তাদের হতাশা।’
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার এবং জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলের সাফল্য অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। তবে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিএনপির কর্মসূচির বিষয়টি এখনো আমার কাছে স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে, এটি বিএনপির দলীয় নাকি কিছু নেতার সিদ্ধান্ত তা আরো দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত হলে ভারতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। তবে এটি কতটা কার্যকর হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি।’
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত—আমাদের বড় পারস্পরিক নির্ভরতা আছে। একটি বড় রাজনৈতিক দল যদি এ ধরনের অবস্থান নেয় তবে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ অনেক ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমার মনে হয়, এ নিয়ে আরো চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ আছে। এটি টেকসই হতে হলে তাদের রাজনৈতিকভাবে টেকসই হতে হবে। রাজনৈতিকভাবে জনগণের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। ভারতেরও প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার তারিক এ করিম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর বাংলাদেশ থেকেও ভারতীয় সেনারা ফিরে গেছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রই তাদের অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দেয়। নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরং সম্পৃক্ত থাকা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি যদি মনে করে, জনগণ তাদের সঙ্গে আছে তাহলে তারা কর্মসূচি পালন করবে এবং ভারতকে তা আমলে নিতে হবে, তাহলে তারা করবে। আমাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে। ভারতেরও আছে। গণতন্ত্র এক ধরনের নয়।’
তারিক এ করিম বলেন, ‘নীতিগত বিষয়ে একেক পক্ষের কর্মকাণ্ড একেক রকম। বিএনপি যে একটি বিশেষ ধারা অনুসরণ করছে তা স্পষ্ট। জনগণ একে কতটা সমর্থন করবে তা সময়ই বলে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে অন্য অঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আমি আগেও বলেছি, প্রতিবেশী প্রতিবেশীই। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। প্রতিটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ধরন ঠিক করে। দুই প্রতিবেশীর জাতীয় স্বার্থ সব সময় একই ধরনের হবে এমন নয়। সম্পর্ক ভালো রাখা এবং যতটা সম্ভব নিবিড় ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখা দুই প্রতিবেশীরই দায়িত্ব।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে বিএনপি সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই লাভ হবে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ ভারতকে বলতে পারবে যে ভারতবিরোধী তথা পাকিস্তানপন্থী ভাবনা বিএনপির যে আছে, তা তারা আগে থেকেই বলে আসছে। এবার আবারও তা প্রমাণ হলো। বরং ভারত বিএনপির সঙ্গে মাঝে যে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেছিল তা কাজে আসেনি।
ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, কোনো দেশকে লক্ষ্য করে বর্জন বা নিষেধাজ্ঞার মতো উদ্যোগ নেওয়ার ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, যাদের লক্ষ্য করে এগুলো করা হয়েছে তারা আরো শক্তিশালী হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরানের উদাহরণ দেওয়া যায়। নিষেধাজ্ঞা বা বর্জন আগেও কোনো কাজে দেয়নি। এর বড় কারণ হলো অর্থনীতি বিশ্বায়নের কাঠামোর মধ্যে পড়ে গেছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এখন সহজেই ভারতীয় পণ্য বা বাংলাদেশি পণ্য বলার সুযোগ আর নেই। কারণ ভারতের পণ্যের মধ্যে একাধিক দেশের কাঁচামাল আছে আবার বাংলাদেশের পণ্যের মধ্যেও একাধিক দেশের কাঁচামাল আছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক যাঁরা দিয়েছেন তাঁরা এসব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করেছেন কি না জানি না।’
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তান বিভাজন আছে। এক কথায়, ভারতবিরোধী হওয়া মানে পাকিস্তানপন্থী হওয়া এবং পাকিস্তানবিরোধী হওয়া মানে ভারতপন্থী হওয়া। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে এসেছে, বিএনপির মধ্যে পাকিস্তানি ছায়া রয়ে গেছে। সেটি আবারও তারা পরিষ্কারভাবে বলা শুরু করেছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকজন ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। পরের দিকে বিএনপির লোকজনও এটি বলা শুরু করেছে। কতখানি চিন্তা-ভাবনা করেছে আমি জানি না।’
তাঁর মতে, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি বিএনপি কিভাবে সামলাবে তা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। এই পরিস্থিতিতে তারা ভারতের পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। এ দেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি করা সহজ। এমনিতেই বাংলাদেশিদের একটি অংশের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিবেশীদের মধ্যে এটি থাকেও।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, বিএনপির কর্মসূচির প্রভাব পড়বে যদি অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় যায়। কিন্তু বিশ্বায়নের কাঠামোর মধ্যে থাকার কারণে যে দেশকে লক্ষ্য করে এ ধরনের বর্জনের ডাক দেওয়া হয় সেই দেশ আরো শক্তিশালী হয়। মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল নেই।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর জনসমক্ষে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। এদিকে গতকাল শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের অবস্থান জন-আকাঙ্ক্ষার বিপক্ষে ছিল বলে ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে সেটা জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। ওই নির্বাচনে ভারত জনগণের বিপক্ষে অবস্থান করেছে। এ কারণে বাংলাদেশের জনগণ এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আমরা দেখতে পারছি যে ভারতীয় পণ্য বর্জন করছে। আমাদের দলের মুখপাত্র রিজভী আহমেদ ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ করেছেন। এই কর্মসূচির প্রতি আমরা সংহতি প্রকাশ করছি।’
ভারতের ওপর কেন এত ‘ক্ষুব্ধ’ মালদ্বীপ?
ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপ থেকে প্রত্যাহার করতে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর আল্টিমেটামের পর আলোচনায় ইস্যুটি। কেন মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরাতে চান মুইজ্জু, এ নিয়ে সম্প্রতি বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদন করেছে এনডিটিভি।
এতে বলা হয়, মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির প্রভাবকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে মালে। চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের বর্তমান সম্পর্কের বিষয়টিও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
চীন থেকে ফিরেই মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় সেনাদের দেশে ফেরত নিতে নয়াদিল্লিকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। ১৫ মার্চের মধ্যেই মালে ছাড়তে হবে ভারতীয় সেনাদের। ভারত সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত মহাসাগরের এ দ্বীপ দেশটিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ৭৭ জন সদস্য অবস্থান করছিলো। সেনাদের পাশাপাশি ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ১২ জন মেডিকেল কর্মকর্তাও মালদ্বীপে মোতায়েন ছিলো।
মালদ্বীপের প্রত্যন্ত দ্বীপের বাসিন্দাদের মানবিক এবং চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য সেনারা দেশটিতে অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছে দিল্লি। গণমাধ্যমটির তথ্য বলছে, নয়াদিল্লির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল মালদ্বীপের মানুষ। অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির হস্তক্ষেপ উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এমনকি ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে দেশের ‘সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। আর তাই ভারতের প্রভাব কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে দেশটিতে থাকা ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত মালদ্বীপ সরকার নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, দেশটি থেকে ভারতীয় সেনাদের সরানোর পিছনে চীনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক কারণে মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে চীন। মালদ্বীপের পাশেই রয়েছে ভারত মহাসাগরের প্রধান ব্যস্ততম সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। যে পথ দিয়ে চীনের তেল আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশই পরিবহন করা হয়। মুইজ্জুর চীন সফরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মালদ্বীপকে ১.৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন; যা দেশটির মোট ঋণের প্রায় ২০ শতাংশের সমান। সবদিক দিয়ে ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনমুখী অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপের বর্তমান সরকার। আর সে কারণেই ভারত-বিরোধী নানা পদক্ষেপ লক্ষ্যণীয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।