ভারতের সিএএ: মুসলিমদের নিয়ে উদ্বিগ্ন তসলিমা নাসরিন
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) চালু হয়ে গেল ভারতে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টানসহ ‘নির্যাতিত’ অমুসলমান অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য আইন শেষ পর্যন্ত চালু হলো। ভারত সরকার জানিয়ে দিয়েছে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য এই আইন তৈরি হয়নি, বরং দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। তারপরও কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের উৎকণ্ঠা কমছে না। তাদের হাতে হয়তো সব নথিপত্র নেই প্রমাণ করার যে তারা ভারতের মুসলমান, বংশ পরম্পরায় তারা ভারতে বাস করছে, এ ক্ষেত্রে যে তাদের অনুপ্রবেশকারী বলে ধাক্কা দিয়ে বের করে হবে না এ দেশ থেকে, তার কী নিশ্চয়তা?
মাঝে মাঝে ভাবী, যে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যখন হয়েছিলই, তখন ভালোভাবেই হওয়া উচিত ছিল। সব হিন্দু ভারতে থাকতো, সব মুসলমান পাকিস্তানে। তাহলে প্রতিবেশী দেশে হিন্দুদের অত্যাচারিত হতে হতো না। ভারতের রাজনীতিকেও ভোটব্যাংক-নির্ভর হতে হতো না, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অসন্তোষ, ঘৃণা, হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতো অনেকে আর হাজার কোটি টাকা খরচ করে আজকের এই সিএএ বা নাগরিকত্ব বিল আর ‘এনআরসি’ বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করারও প্রয়োজন পড়তো না। এটিকে সাদা বাংলায় বলা যায়, ‘অনুপ্রবেশকারী মুসলমান বিতাড়ন’।
অনুপ্রবেশকারী অমুসলমানদের আজ না হোক কাল ভারতের নাগরিক করে নেওয়া হবে, প্রয়োজনে নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করে সেই ব্যবস্থা হবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবে না। দ্বিমত করবে মুসলমানের বেলায়, এ সকলেই জানে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে জঙ্গি মুসলমান তো কম আসেনি ভারতবর্ষে। ভারতের মাটিতে জঙ্গি হামলাও কম হয়নি। তাদের সন্ত্রাস এই মুসলমানবিরোধী আইন তৈরির পেছনে বড় একটি কারণ। তাছাড়া মুসলমানের বাস করার জন্য প্রচুর মুসলমান অধ্যুষিত দেশ আছে পৃথিবীতে, হিন্দুর জন্য ভারতই একমাত্র ‘প্রমিজল্যান্ড’। এটিকে তাই যতটা সম্ভব সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর নিরাপত্তার জন্যই রাখা হচ্ছে। হিন্দুর নিরাপত্তা বারবার প্রতিবেশী দেশগুলোয় ব্যাহত হয়েছে, সে মুসলমানের কারণেই। তাই ভারতের অধিকাংশ লোক মুসলমানদের, বিশেষ করে অভিবাসী মুসলমানদের, আর বিশ্বাস করতে চায় না।
অমুসলমানদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে আর মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু আসামে যে ১৯ লাখ নাগরিকের তালিকা করা হয়েছিল চার বছর আগে, ওতে ১২ লাখই ছিল হিন্দু। নাগরিকপঞ্জির তালিকা করা সহজ নয়। যে দেশে মানুষের জন্ম মৃত্যু নথিভুক্ত করাটা বাধ্যতামূলক নয়, সে দেশে ‘তুমি যে এ দেশের নাগরিক তার প্রমাণ দেখাও’ বলে হাঁক দিলে কী দেখাবে সে? আধার কার্ডের নামের সঙ্গে রেশন কার্ডের নামের মিল নেই। কবে কোন দেশ থেকে কী কারণে এসেছে তার কোনও নথি নেই। কারও কারও নথি বানের জলে ভেসে গেছে। ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার দুশ্চিন্তায় এরা কেউ গলায় দড়ি দিচ্ছে, কেউ কুয়োয় ঝাঁপ দিচ্ছে। পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ফেলে কোথায় যাবে এরা? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না। যে তালিকা বের করা হয়েছে, তাতে মা-বাবার নাম আছে তো সন্তানের নেই, স্বামীর নাম আছে স্ত্রীর নাম নেই। একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয়েছে বটে। তালিকায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নাম নেই। মোহাম্মদ সানাউল্লাহ একটানা চার বছর জম্মু-কাশ্মীরের উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। মহিরুদ্দিন আহমেদ ১৯ বছর হাবিলদার হিসেবে সরকারি চাকরি করেছেন। কারও নাম ওঠেনি নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায়। দু’জনেরই স্ত্রী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বাদ পড়েছেন সন্তানরা। তেমনই নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় ঠাঁই হয়নি বিধায়ক অনন্তকুমার মালোর। আসামে নাগরিকপঞ্জির তালিকা শুরু হওয়ার মূল কারণটি হলো ‘অসমীয়া জাতীয়তাবাদ’। মূলত ‘বাঙালি খেদাও আন্দোলন’। এখন বিবর্তিত হয়ে এটি দাঁড়িয়েছে ‘মুসলমান খেদাও আন্দোলনে’।
শুনেছিলাম ডিটেনশান ক্যাম্প বা বন্দী শিবিরও নাকি তৈরি হয়েছিল। যাদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে ওঠেনি, তাদের কাজ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কাছে গিয়ে আবেদন করা। কিন্তু সেই আবেদনের পরেও যদি নাম নথিভুক্ত না হয় তাহলে এই অগুনতি অনাকাক্সিক্ষত মানুষকে পাঠানো হবে বন্দী শিবিরে। এই বন্দী শিবির এক ধরনের কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প। শুনেছি আসামে বন্দী শিবির আছে ৬টি। এ ছাড়াও আরও বন্দী শিবির বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব শিবিরে এক পরিবারের হলেও নারী-পুরুষকে আলাদা থাকতে হবে। হয় বাংলাদেশ, নয় বন্দী শিবির। তালিকায় যাদের নাম নেই, দুটো গন্তব্যই তাদের জন্য রাখা।
আসাম চুক্তিতে বলা ছিল ১৯৭১-এর ২৪ মার্চকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা তৈরির তারিখ ধরা হবে। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যারা বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছে, তারা তালিকায় থাকবে। আবার এও বলা হয়েছিল, ২০০৪-এর ৩১ ডিসেম্বরের আগে যারা এসেছে, তারা নাগরিকত্ব পাবে। আবার এও কেউ কেউ বলছে, নাগরিকত্ব আইন মেনে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারিকে সময়সীমা ধরা হবে। শেষঅবধি কী করা হয়েছে, তা আমার মতো অনেকেই জানে না। জানি না সরকারই হয়তো জনগণকে স্পষ্ট করে নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপঞ্জি সম্পর্কে সবকিছু বুঝতে দিতে চায় না।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, হিন্দুদের ভারতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, কারণ তারা বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। আবার এও বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব পেতে গেলে প্রমাণ করতে হবে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েই এ দেশে আসতে হয়েছে। কিন্তু কীভাবে হিন্দুরা প্রমাণ করবে যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছে? নিপীড়নের প্রমাণপত্র কি বাংলাদেশের সরকার দেয়? দিয়েছে কাউকে কখনও? লক্ষ লক্ষ মুসলমানের মতো লক্ষ লক্ষ হিন্দুও কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক সুবিধের জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসে। তাহলে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার না হলে সে কি ভারতে নাগরিকত্ব পাবে না? প্রচুর প্রগতিশীল মুক্তচিন্তক মুসলমানও কিন্তু বাংলাদেশে কট্টর মুসলমান মৌলবাদী দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়। তাছাড়াও বাংলাদেশে আহমদীয়া মুসলমানরা সুন্নি মুসলমান মৌলবাদী দ্বারা এবং পাকিস্তানের শিয়া আর আহমদীয়া মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি দ্বারা তো বটেই, সরকার দ্বারাও নির্যাতিত। তারা তো ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। তাদের কি নাগরিকত্ব দেবে ভারত? প্রশ্নই ওঠে না। শুধু হিন্দুর বেলায় ভারত উদার। কিন্তু ভারতের সংবিধানের কোথাও তো হিন্দুর জন্য আলাদা উদারতার কথা লেখা নেই!
ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। সংবিধানে সব ধর্মের, বর্ণের, জাতের, গোত্রের, লিঙ্গের, ভাষার মানুষ সমান। যদি সংবিধান মেনে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হয়, তবে সবাই বিচার পাবে, এ নিয়ে সংশয় নেই। দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচনে জিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সংবিধানে মাথা ঠেকিয়েছিলেন। তাঁর সরকারের তো উচিত সংবিধানের নীতিমালা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা!
ভারতে এ তথ্য সকলেরই জানা যে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি-মুসলমান বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকেছে অর্থনৈতিক কারণে। গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে ঢোকার প্রবণতা মানুষের চিরকালের। বাংলাদেশের চেয়ে তুলনায় ভারত ধনী দেশ। তাই যে ধর্মেরই হোক, বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারতে পাড়ি দিয়েছে। আমাদের আদি নারী-পুরুষরা আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে ভালো খাদ্য, ভালো পানীয়, ভালো আবহাওয়া, ভালো পরিবেশের সন্ধানে স্থান বদলেছে। না বদলালে হয়তো মানুষ প্রজাতিটাই বিলুপ্ত হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে বাঙালি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সুযোগ পেলে চলে যায় ইউরোপ-আমেরিকায়। যারা ওই সুযোগটা পায় না, তারা যায় এশিয়ার ধনী দেশগুলোয় স্থায়ী বসবাসের জন্য। একেবারেই যারা অভাগা হতদরিদ্র, তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেই চলে আসে, যদি খেটেখুটে ভালো টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারে, যদি খাওয়া-পরাটা চলে, যদি স্বাস্থ্য শিক্ষাটা নির্বিঘ্নে পায়।
দুনিয়ার মানুষ এভাবেই ভালো জীবনযাপনের আশায় এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যায়। সেই যে চার-পা ছেড়ে দু-পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকে শুরু হয়েছে, আজও চলছে। ভারতীয়রাও তাই করে। তারাও ভারতের চেয়ে উন্নত দেশে পাড়ি দেয় উন্নততর জীবনের জন্য। আফ্রিকার এবং এশিয়ার বিভিন্ন গরিব দেশের লোকদের, তাদের মধ্যে ভারতীয়ও আছে, প্রায়ই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে ঘোষণা করে পাশ্চাত্যের সরকার। তারপর এক সময় সবাইকেই মানবিক কারণে বৈধ বসবাসকারী হিসেবেই মেনে নেয়। কিছুকাল পর নাগরিকত্বও দিয়ে দেয় সবাইকে। আমরা পাশ্চাত্যের অজস্র মন্দ জিনিস শিখি, কিন্তু ওদের ভালো জিনিস- ওদের মানবাধিকার, নারীর অধিকার, ওদের বাকস্বাধীনতা, ওদের মহানুভবতা- মোটেও শিখতে চাই না।
তসলিমা নাসরিন : নির্বাসিত লেখিকা