এক্সক্লুসিভ

যে মানুষটি পাখিপ্রেমেই কাটিয়ে দিলেন ৮৭ বছর

পাবনার বেড়া উপজেলার কাগেশ্বরী নদীর ধারে কৈটলা গ্রাম। চারদিকে সবুজ গাছপালা আর অসংখ্য খাল বিলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই গ্রামেই সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে পাখির অভয়াশ্রম। ব্যক্তি উদ্যোগে এটি গড়ে তুলেছেন আকাশ কলি দাস।
চিরকুমার এ মানুষটি পাখিপ্রেমেই কাটিয়ে দিলেন তার জীবনের ৮৭টি বছর। পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এলাকায় তিনি ‘পাখিবন্ধু’ নামে পরিচিত। তার প্রকৃতি সেবায় সাথী হয়েছেন তার ছোট বোন ৬২ বছর বয়সী ঝর্ণা দাস। তিনিও ঘর সংসার করেননি। এ দেশে আত্মীয়-স্বজন বলতে আর কেউই নেই তাদের। যারা আছেন, তারাও স্বাধীনতার আগে চলে গেছেন ভারতে।

বাবা মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে বড় আকাশ কলি দাস। বাবা চন্দ্র কুমার দাস ছিলেন পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ীর শ্রী নিবাস দিয়ার জমিদার বাড়ির নায়েব। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। হারিয়ে যায় তার কৈশোর। পরে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি স্থানীয় মাছখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

নব্বইয়ের দশকে চাকরি থেকে অবসরে যান আকাশ কলি দাস । নিজের জীবনের প্রতি উদাসীন থাকলেও পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব ঠিকই কাঁধে তুলে নেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের বিয়ে দেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তার আর যোগাযোগ হয়নি ভাইয়ের সঙ্গে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কৈটোলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে বয়ে গেছে ছোট্ট কাগেশ্বরী নদী। মরা নদীর দু’ধার সবুজে ঘেরা। এর পাড়েই কৈটোলা গ্রামে আাকশ কলির সাড়ে ছয় বিঘা সম্পত্তি যেন একটি ছোট্ট জঙ্গল। এ জঙ্গলে রয়েছে আম, কাঁঠাল, পাপনা, দেবদারু গাছ এবং ভারতীয় পার্সিমন, গাউবিসহ দেশি-বিদেশি অনেক গাছ। সব গাছই লাগানো হয়েছে পাখিদের কথা চিন্তা করে। নিজের বসতভিটা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন পশুপাখিদের জন্য।

পুরনো মাটির চার চালা ঘরে বসবাস করেন দুই ভাই বোন। আরেকটি ছোট দোচালা ঘরে চলে ভাই-বোনের রান্নাসহ আনুষঙ্গিক কাজ। পাশে দুইটি গোয়াল ঘরও রয়েছে। তার ঘরের বেড়ার সঙ্গে পাখিদের জন্য ডালি বাধা। বাড়ির আশেপাশে শুনশান নীরবতা। তবে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ পাখির কলতানে মুখর হয়ে আছে। ঝোপ-জঙ্গলে দেখা মেলে অচেনা পাখিদের। কুকুর-শিয়াল-সরীসৃপও দেখা যায়। আছে অতিথি পাখি।

বসতভিটায় সাড়ে ৬ বিঘার সম্পত্তির পাশাপাশি মাঠেও রয়েছে বেশ কিছু জমি। তার জীবনযাপন সাদা-মাটা। বাড়িতে তারা দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই। সম্পত্তি নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা বা মোহ নেই। গরু ও মাঠের কাজে জন্য রাখাল ও শ্রমিক আছে। তবে তারা কাজ শেষে যে যার বাড়িতে চলে যান।

প্রতিবেশীরা জানান, মাঝে মাঝে আকাশের দেখা পাওয়া গেলেও কখনো বাইরে আসেন না ঝর্ণা।

আকাশ কলি দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন যুগ আগে এখানে পাখি আসতে শুরু করে। প্রথম প্রথম দেশি পাখি আসলেও পরে অতিথি পাখিরাও আসতে শুরু করে। মূলত খাদ্যের পর্যাপ্ততা ও শিকারীদের দৌরাত্ম্য কম বলে এখানে পাখি আসে। পাখির আগমন দেখে তিনি পাখিদের প্রেমে পরেন। তাদের ভালোবেসে ফেলেন। চিন্তা করেন এখানে পাখিরা থাকবে নিরাপদে। তাই বনের কোন গাছ তিনি বিক্রি করেন না। শিকারীরা প্রথম ঝামেলা করলেও গ্রামের মানুষের সাহায্যে তিনি সেসব মোকাবেলা করেছেন। কয়েক বছর আগে সরকারিভাবে এবং ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট এ স্থানটিকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে বর্তমানে পাখির উপস্থিতি কয়েক বছরের তুলনায় কমে গেছে। অভয়াশ্রমে পাখি শিকার না করলেও আশেপাশে প্রচুর পাখি শিকার হয়। ফলে খাদ্যের খোঁজে নদীর তীর বা ধান ক্ষেতে গিয়ে অনেক পাখি আর ফিরে আসে না।

আকাশ কলি দাস বলেন, পাখি মাঠে গেলে মানুষ বিভিন্নভাবে শিকার করে। তাই ওরা এখানে এসে নিরাপদ স্থানে থাকে। পশুপাখি ভালোবাসি। গাছগাছালি কাটি না; যাতে করে ওরা থাকতে পারে। আমি ওদের পাহারা দিয়ে রাখি। যাতে পাখিদের ওপর অত্যাচার না হয়, সে জন্য আমি ধীরে ধীরে এই জঙ্গল গড়ে তুলেছি। পাখিদের নিরাপত্তাই আমার একমাত্র দাবি।

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আকাশ কলি দাসের দাবি, ঠিক কী কারণে তিনি বিয়ে করেননি তা তিনি জানেন না। আর বোন কী কারণে বিয়ে করেননি তাও জানেন না তিনি। তবে সংসার জীবন পছন্দ হলেও ভাই-বোনদের বিয়ে ও দায়িত্ব নেওয়ার কারণে বিয়ে করা হয়নি বলে জানান তিনি। তবে বোন ঝর্ণাকে প্রথমে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পরে রাজি না হওয়ায় তাকেও আর বিয়ে দেননি।

এলাকার মানুষের মুখে শোনা যায়, পাখিদের ভালোবেসেই তিনি বিয়ে করেননি। সারাদিন বনে বনে পাখির খোঁজ খবর নেয়া, কোনো পাখি আহত বা অসুস্থ হলে তার সেবা করা আবার শিকারীদের হাত থেকে পাখিদের বাঁচানোর চেষ্টা এসব নিয়েই সময় কেটেছে তার। এখন নিরিবিলি জীবন কাটাতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ঝর্ণা দাস বেশির ভাগ সময় বই পড়ে সময় কাটান। ভাই আকাশ কলি দাস বইয়ের পাশাপাশি পশু-পাখি ও প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান। তার একাকিত্বের কিছু সময় লাঘব করেন এই পশু-পাখি ও প্রকৃতি।

তিনি জানান, এক শ্রেণির ইউটিউবারদের জ্বালায় তিনি অতিষ্ঠ। তারা এসে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়িতে এসে ঘোরা ফেরা করেন। ড্রোন উড়িয়ে ছবি তোলেন। এতে পাখি উড়ে যায়। তার ব্যক্তিগত জীবন নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিবেশীরা জানান, ছোটবেলা থেকেই এ জঙ্গলে পাখির আসা-যাওয়া দেখি। কেউ পাখি শিকার করতে এলে কলি দাস তাদের বাধা দেন। তিনি মানুষ হিসেবে অনন্য।তিনি পশু-পাখির জন্য যেমন উদার তেমনি মানুষের বিপদ আপদে এগিয়ে যান।

কৈটোলা ইউপি চেয়ারম্যান মহসিন উদ্দিন পিপল বলেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল মানুষ। তার দানে অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হয়েছেন। আমাদের এলাকার অনেক কিছুতেই তার অবদান রয়েছে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, পাখিদের জন্য যে আশ্রয়টুকু থাকা দরকার, সেটার তেমন ব্যবস্থা নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে আকাশ কলি দাসের প্রকৃতি সংরক্ষণ ও পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলা কাজ মহৎ উদ্যোগ। এটি একটি ভালো উদ্যোগ ও শিক্ষণীয় ব্যাপার। নতুন প্রজন্মের কাছে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য আকাশ কলি দাসের প্রকৃতি প্রেম উদাহরণ হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button