প্রায় দুই বছরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর গত বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানে বহুল কাঙিক্ষত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে কারাবন্দী নেতা ইমরান খানের সমর্থিত প্রার্থীরা শীর্ষে উঠে এসেছেন। এখন সরকার গড়তে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ।
সহিংসতা, অনিয়ম ও অভিযোগের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ভোটগ্রহণ হলেও ফলাফল প্রকাশের সময় শুরু হয় টালবাহানা। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১২ ঘণ্টা পর খুবই ধীর গতিতে শুরু হয়েছিল বেসরকারি ফলাফল প্রকাশ।
এরপর নির্বাচনের তিনদিন পর রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে যখন নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৬৫ আসনের মধ্যে নওয়াজের দল পিএমএল-এন মাত্র ৭৫টি আসন পেয়েছে। আর পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ১০১টি আসন।
পিটিআই’র অভিযোগ, নির্বাচনের ফল কারচুপি করা হয়েছে। তাদের প্রার্থীরা অন্তত ১৭০টি আসন জিতেছেন। কিন্তু ফল কারচুপির মাধ্যমে তাদেরকে প্রয়োজনীয়তা সংখ্যাগরিষ্ঠতা (এককভাবে সরকার গড়তে ১৩৪ আসন দরকার) থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশটির জনগণও পিটিআইকে জনসমর্থন দিয়েছে তা নওয়াজ ও তার দল পিএমএল-এনের জন্য ‘চুরি করা হয়েছে’। ফল কারচুপির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে রাজপথে নেমেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) ও আদালতে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন।
প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর আশীর্বাদের পরও কী এমন ঘটলো যে, পাকিস্তানি জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিলো?- এটা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বেশির জনমত জরিপেই পিটিআই’র চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিল পিএমএল-এন। সেই সঙ্গে ভোট ব্যাংক পাঞ্জাবেও দলটির অবস্থান আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী বলেই বিবেচনা করা হচ্ছিল।
পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদর আলম বলছেন, পিএমএল-এনের এই হতাশাজনক ফলাফলের শিকড় ২০২২ সালের এপ্রিল ও এর পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। যখন অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খান ও তার পিটিআই নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করা হয়। সে সময় নওয়াজ শরিফ লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকলেও তার দল পিএমএল-এন, পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি) ও সমমনা আরও কয়েকটি দল ইমরান খানের পতনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট নামে আন্দোলন গড়ে তুলে সফল হয়। তবে যখনই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন তার মনোযোগ চলে গেল বড় ভাই শাহবাজ শরিফকে সব মামলা ও দণ্ড থেকে মুক্ত করার দিকে।
জানা গেছে, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এই মামলাগুলো শরিফদেরকে গত প্রায় তিন দশক ধরে তাড়া করে ফিরছে। নওয়াজ শরিফ নব্বইয়ের দশকে দুইবার দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছেন। তখন থেকেই তিনি দুর্নীতির অভিযোগ অভিযুক্ত। ১৯৯৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে আবারও ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। কিন্তু ইমরান খানের পিটিআই’র তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তার পিছু ছাড়েনি। সেই দুর্নীতির অভিযোগেই ২০১৭ সালে তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন বিষক ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি বোর্ড (ন্যাব)।
এরপর অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআইয়ের কাছে হারে পিএমএল-এন। ওই নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান ইমরান খান। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। কিন্তু অল্পদিনেই খান ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক তীক্ত হয়ে ওঠে এবং অবশেষে ২০২২ সালের এপ্রিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান।
বদর আলম বলেন, মনে করা হয় ইমরানের পতনের পর সেনাবাহিনীর হাত ধরেই পিএমএল-এন ও পিপিপির জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপরই পাকিস্তান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে পড়ে এবং সময়ের পরিক্রমায় সেই সংকট বৃদ্ধি পাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালমান গনি বলেন, পিডিএম জোটের প্রধান দল হওয়ার কারণে সরকারের সব সিদ্ধান্ত নিতেন শরিফ ভাইয়েরা। পিডিএম জোটের ১৬ মাসের শাসনকালে পিএমএল-এনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই সরকারের অধীনেই পাকিস্তানে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। যা সাধারণ জনসাধারণের জীবনে নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। যার পরিণামে ভোটব্যাংক সংকুচিত হয়েছে। মানুষ আর্থসামাজিকভাবে সুবিধা পাওয়ার জন্যই পিএমএল-এনকে সমর্থন করে, আদর্শের জন্য নয়। কিন্তু ১৬ মাসের শাসনকালে মানুষের সেই উপলব্ধিটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা এখন শোচনীয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপিরও দ্রুত অবমূল্যায়ন হচ্ছে। গত বছর ঋণখেলাপি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল দেশটি। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপির হওয়ার হাত থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে।