বাংলাদেশি শ্রমিকরা আরবি-ইংরেজি না জানায় পিছিয়ে

দেশে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) নিয়ন্ত্রণাধীন দুই প্রতিষ্ঠানে জাপানি, কোরিয়ান, ইংরেজি ও চাইনিজ ভাষা শিক্ষার কোর্স চালু আছে। অথচ প্রবাসীদের আগ্রহ নেই এমন দোহাই দিয়ে সাত বছর আগে আরবি ভাষা কোর্স বন্ধ করেছে বিএমইটি। এখন পর্যন্ত সেই কোর্স চালু করা হয়নি। অথচ গত অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি দেশে সাড়ে ৭ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন। এসব দেশের ভাষা আরবি হলেও শ্রমিকরা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে অদক্ষ অবস্থায় দেশ ছাড়েন।

বড় শ্রমবাজারের মধ্যে অন্যতম মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ওমান। লেবাননেও যাচ্ছেন দেশের কর্মীরা। এসব দেশে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন রকম অসুবিধায় পড়ার অন্যতম কারণ ভাষাদক্ষতা না থাকা; বিশেষ করে ভালো কাজ থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে এ কারণে। এতে অন্যদের মতো কাজ করেও শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিএমইটির অধীনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোর্স চালু থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া ইংরেজি ভীতি থাকায় অনেকে ভাষা শিখতে আগ্রহ দেখান না। কিন্তু তাদের ভাষা আয়ত্ত করাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এতে প্রতি বছর ভাষা শিক্ষা ছাড়াই কর্মীদের বড় অংশই বিদেশ যাচ্ছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, গন্তব্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশি কর্মীরা নিয়োগদাতাদের কথাবার্তা সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না, ভাষাগত এই বাধার কারণে তাদের চাহিদার কথাও জানাতে পারেন না। এটি তাদের নিপীড়িত হওয়ার অন্যতম কারণও। ভাষাগত এই বাধার কারণে, তারা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে এবং শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হলে বিচার চেয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরের শমসের মুবিন দেখে দেখে আরবি পড়তে পারলেও বলতে পারেন না। পাঁচ বছর আগে কাজের সন্ধানে সৌদি আরবে যান তিনি। যাওয়ার আগে ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। নিজে জানারও চেষ্টা করেননি। কারণ দালালরা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যান। আরবি ভাষা না জানায় শুরুতে ভালো কাজ পাননি শমসের। পরে একটি কোম্পানিতে চাকরি মিললেও ভাষাদক্ষতা না থাকায় অন্যদের তুলনায় কম বেতন পেতেন। মাস শেষে সর্বসাকল্যে ১ হাজার রিয়াল পেতেন তিনি, বাংলাদেশি টাকায় যা ২৯ হাজার টাকা। অথচ ভাষাদক্ষতা থাকায় একই কাজ করে অন্য এক শ্রমিক মজুরি পান ১ হাজার ৫০০ রিয়াল। ৫ মাস কাজের সূত্রে শমসের অন্যদের কাছ থেকে শুনে ও অধ্যয়ন করে আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন। এখন তিনি একটি ফার্মেসিতে ১৬০০ রিয়ালে চাকরি করেন, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৬ হাজার।

শমসের মুবিনের মতো হাজারো শ্রমিক প্রতি বছর ভাষা শিক্ষা ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমান। যাদের অধিকাংশ অল্প মজুরিতে চাকরি করেন। অনেকে প্রত্যাশার থেকে কম বেতন পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। তবে যারা সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যান, তাদের বেতনে সমস্যা হয় না। তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পেয়ে থাকেন।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সৌদি আরবে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯৮ হাজার ৪২২, কুয়েতে ৩৬ হাজার ৫৪৮, ওমানে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩, কাতারে ৫৬ হাজার ১৪৮ জন গেছেন। সবগুলো দেশের ভাষাই আরবি।

প্রতি বছর এত সংখ্যক শ্রমিক গেলেও তাদের ভাষা প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা কর্মক্ষেত্রে ভোগান্তিসহ ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

রংপুরের সাখাওয়াত হোসেন ছয় বছর আগে সৌদি আরব যান। যাওয়ার আগে ওই দেশের পরিচিতদের মাধ্যমে ভাষা শিখে আসার পরামর্শ পান। তাই বেসরকারিভাবে আরবি ভাষা শিখে আরব আমিরাতে পাড়ি জমান। সেখানে ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভাষা আয়ত্ত থাকায় প্রত্যাশা অনুযায়ী উপার্জন করতে পারেন। সে দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারায় ভোগান্তিতেও পড়তে হয় না। মাস শেষে তিনি ১ হাজার ৫০০ রিয়ালের মতো উপার্জন করেন।

দেশে বিদেশি ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে খুবই কম। শহর পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে নেই বললেই চলে। ফলে বিদেশগামী শ্রমিকরা ভাষা শিখতে অনীহা দেখান। বিদেশে যাওয়ার পর তারা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন। তবে দেশে সরকারিভাবে জাপানি, কোরিয়ান, ইংরেজি এবং চাইনিজ ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকলেও আরবি ভাষা শিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে স্বল্পমেয়াদি আরবি ভাষা কোর্সে ভর্তির সুযোগ থাকলেও সবার জন্য তা প্রযোজ্য নয়।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে জাপানি ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র রয়েছে ৪৩টি, ৩২টি কোরিয়ান, ১৬টি ইংরেজি আর চাইনিজ ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে ৪টি। তবে আরবি ভাষা শিক্ষার কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। অথচ গত বছর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী গেছেন সৌদি আরবে।

গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতায় সারা দেশে ৯৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৪টি দেশের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। ৬ মাস মেয়াদে ৮০০ জন জাপানিজ ভাষা শিখেছেন। এ ছাড়া ৬ মাস মেয়াদে কোরিয়ান ভাষা শিখেছেন ৮০৫ জন, ২ মাস মেয়াদে ইংরেজি ভাষা শিখেছেন ৭২৮ জন এবং ৩ মাস মেয়াদে চাইনিজ ভাষা শিখেছেন ৯০ জন। গত অর্থবছরে মোট প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৪২৩। অথচ ওই সময় প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

বিএমইটির তথ্যমতে, এখন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও হংকংয়ে শ্রম অভিবাসনের জন্য ভাষা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব দেশের বিধিমালা মেনেই তা করা হয়েছে, তাই এসব অঞ্চলে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের কোনো জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

এদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনশক্তি রপ্তানি গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা এক মাসের বাধ্যতামূলক আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভাষা শেখার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের করা ‘বিদেশে অভিবাসী কর্মীদের মৌলিক পরিষেবা এবং অভিগম্যতার মূল্যায়ন’ শীর্ষক গবেষণামতে, প্রায় ৬৫ শতাংশ অভিবাসী কর্মী গন্তব্যের দেশগুলোতে দরকারি স্বাস্থ্য সেবাবঞ্চিত। খাদ্য ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা পাচ্ছেন না যথাক্রমে ৬৯ ও ৪৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিচালনা) মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, সাত বছর আগে আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্স ছিল। শুরুর দিকে কিছুটা সাড়া মিললেও পরে শিক্ষার্থী কমে যায়। এ জন্য এখন এ কোর্সটি বন্ধ আছে। সৌদি আরবে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় শ্রমিকরা আগ্রহ দেখান না।

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সারা দেশে আবার আরবি ভাষা কোর্স চালুর জন্য আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেই মোতাবেক কাজ শুরু করেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘বাংলাদেশে অল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ লোকদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এর মূল কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাষা শিক্ষার সুযোগ কম। এই সুযোগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অদক্ষদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। তাই সরকারকেই প্রাথমিকভাবে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে; যাতে শ্রমিকরা ভাষাদক্ষতা অর্জন করেই বিদেশে যেতে পারেন।’

Exit mobile version