সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন কমপক্ষে ১৫ জন অভিনেত্রী। এতে ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলটির ত্যাগী নেত্রীরা। বলছেন, অভিনেত্রীরা আমাদের মতো কর্মীদের কিসমত মেরে খেতে এলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের ভোটগ্রহণ হবে ১৪ মার্চ। এর মধ্যে ৪৮টি আসনে মনোনয়ন দিতে পারবে আওয়ামী লীগ। এসব আসনে শাসক দলটির মনোনয়ন পেতে ফরম কিনেছেন ১ হাজার ৫৪৯ জন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ জন অভিনেত্রী, দু-একজন ছাড়া কারও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।
অভিনেত্রীদের সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য ফরম কেনার হিড়িক নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। সেটা যেমন মূল দলে তেমনি সহযোগী সংগঠনগুলোতেও। তাদের বক্তব্য হলো, দলের দুঃসময়ে মাঠে জীবন ক্ষয় করেছি আমরা। আর দলের সুসময়ে এসে দুধের মাছি ভিড় জমাবে আর ত্যাগীরা বঞ্চিতই থেকে যাবে এটা হতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, ‘একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংসদ সদস্য হন। সেখানে থাকে ত্যাগ, শ্রম-ঘামের নানা অবদান। রাজনীতি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীর জীবন গেছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
‘অনেক সংগ্রাম আর কাঠ-খড় পুড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকারে এসেছে। আজ যেভাবে রঙিন পর্দার নারীরা সংরক্ষিত আসনে এমপি হতে চাইছেন, সেটাকে ধিক্কার জানাই।’
মনোনয়ন ফরম বিক্রির শেষ দিনে বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী অভিনেত্রীর ভীড় দেখে ক্ষোভ উগড়ে দেন রাজপথ কাঁপানো যুব মহিলা লীগের নেত্রী আসমা আক্তার রুনা।
বর্তমানে সংগঠনটির সহ-সভাপতি পদে থাকা এই নেত্রী বলেন, ‘রাজনীতিতে এসে জীবন-যৌবন নষ্ট করছি। জেল খেটেছি, নিজের পাঁচটা বাড়ি বিক্রি করছি। স্বামীও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কী লাভ হলো এতো সব ত্যাগ করে?
‘দলের দুর্দিনে রাজপথে ছিলাম। সেই অধিকার নিয়ে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন ফরম কিনতে এসেছি। এসেই হতাশ হইয়া পড়লাম। নায়িকাদের বেল দেখে হতাশ না হইয়া পারছি না। এই নায়িকারা কই ছিল এতদিন? রাজপথে তো তাদের কাউকেই দেখি নাই কোনোদিন। এরা যদি আমাদের মতো কর্মীদের কিসমত মেরে খাইতে আসে, তাহলে আমরা কই গিয়ে দাঁড়াব।’
প্রসঙ্গত, রুনাসহ যুব মহিলা লীগের এক ঝাঁক নেত্রী ২০০৫-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশংসা কুড়ান।
আওয়ামী লীগের ফরম সংগ্রহকারী অভিনেত্রীরা হলেন- সুবর্ণা মোস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, শমী কায়সার, নিপুণ আক্তার, সোহানা সাবা, শামিমা তুষ্টি, অপু বিশ্বাস, তানভিন সুইটি, মেহের আফরোজ শাওন, শাহনূর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, জাকিয়া মুন, তারিন জাহান, মাহিয়া মাহি, সিমলা প্রমুখ।
এদের মধ্যে সুবর্ণা মোস্তফা গত সংসদে (একাদশ সংসদ) সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি ছিলেন। আর মাহি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। আর ভোট পান মাত্র নয় হাজারের মতো।
রোকেয়া প্রাচী সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ছাড়াও সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে অভিনেত্রী তারানা হালিম, চিত্রনায়িকা জ্যোতিকা জ্যোতি, গায়িকা মমতাজ বেগম দলটির সক্রিয় রাজনীতি করেন।
তারানা হালিম দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। চিত্রনায়িকা জ্যোতিকা জ্যোতি ও গায়িকা মমতাজ বেগম দলটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। যদিও এই তিনজন সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য ফরম কিনেছেন কী না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার বলেন, ‘ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর থেকেই পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। জেলা সফরে গিয়েও যোগ্য কাউকে দেখলে তার নাম লিখে রাখেন। সময়মতো সেটা কাজে লাগান।’
বৃহস্পতিবার কাদের জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এবার ৫০টির মধ্যে ৪৮ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য দিতে পারবে আওয়ামী লীগ।
রাজনীতি না করেও অভিনেত্রীদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার বাসনার তীব্র সমালোচনা করেছেন নির্বাচন নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘যারা কোনোদিন জনগণের কাছে যাননি, মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচয় নেই, তারা সংসদ সদস্য হতে চান। অভিনেত্রীরা জনপ্রতিনিধি হতে যান, যা কোনোভাবেই রাজনীতি ও জনকল্যাণ বয়ে আনবে না।