অন্য তারকাদের মতো তারও একটি ক্যারিয়ারগ্রাফ আছে, তবে তাতে কোনো পতন নেই, কেবলই উত্থান। তিনি আর কেউ নন, প্যান-ইন্ডিয়ান মুভির সবচেয়ে আলোচিত তারকাদের একজন মোহনলাল বিশ্বনাথ ওরফে ।
৬৩-তে পা রাখা মোহনলাল একই সঙ্গে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক-পরিবেশক এবং প্লে-ব্যাক গায়ক। মূলত মালায়লাম ছবিতেই প্রথম নিজেকে ব্রেক দেন তিনি। এরপর কাজ করেছেন তামিল, তেলুগু, কন্নড় এবং বলিউডে।
বিশ্বনাথ নায়ারের সবচেয়ে ছোট ছেলেটির জন্ম ১৯৬০ সালের ২১ মে, কেরালার এলানথোর গ্রামে। বাবা ছিলেন ব্যুরোক্র্যাট, ল পারসনালিটি। বাবা চাননি তার গোত্রের নাম তার ওপর বর্তাক। তাই ছোটবেলার রোশনলাল নায়ার পরে হয়ে যান মোহনলাল বিশ্বনাথ।
লেখাপড়ার পাশাপাশি মাঝে মাঝে অভিনয় করতেন তিনি। তবে তিনি জীবনে প্রথম যে চরিত্রে অভিনয় করেন সেটির বয়স ছিল নব্বইয়োর্ধ্ব পুরুষের।
মোহনলাল সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হয়তো অনেকেই জানেন না মোহনলাল ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত কুস্তিগির। ১৯৭৭-৭৮ সালে তিনি ছিলেন কেরালার কুস্তি চ্যাম্পিয়ন।
নিজের এবং কাছের বন্ধুদের প্রয়োজনায় করা একটি মালায়লাম ছবি ‘থিরানোত্তম’-এর মাধ্যমে অভিনয় জীবনে অভিষেক ঘটে এই মহাতারকার। ১৮ বছর বয়সী মোহনলাল ছবিটিতে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন গৃহকর্মীর চরিত্রে অভিনয় করেন। তবে সেন্সর-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ছবিটি তখন আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ২৫ বছর পরে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়, তবে অধিক সেন্সর করার পর। আর এ বিষয়টিকেই মোহনলাল তার জীবনের অন্যতম ট্র্যাজিক বিষয় বলে অভিহিত করেন।
১৯৮০ সাল। ফাজিলের (প্রখ্যাত দক্ষিণী প্রযোজক-পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার আব্দুল হামিদ মুহাম্মদ ফাজিল) প্রথম সিনেমা ‘মানজিল ভিরিঞ্জা পুক্কাল’ (তুষারে ফোটে যে ফুল)-এ নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ আলোচনায় আসেন মোহনলাল। ২০০৪ সালে রিডার্স ডাইজেস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মোহনলাল বলেছিলেন, ২০ বছর বয়সী কোনো যুবকের জন্য ভিলেন চরিত্রে রূপদান সত্যিই কঠিন ছিল। তবে আমি সেটা সফলভাবে করতে পেরেছিলাম বলেই এখন মনে হয়।
১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ২৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেন মোহনলাল। অধিকাংশ চরিত্রই ছিল অ্যান্টিগনিস্ট বা নেগেটিভ। তবে এ সময় একাধিক ছবিতে সরলমন নায়ক চরিত্রেও দেখা যায় তাকে।
নায়িকাকে ‘বড়লোকের মেয়ে’ ভেবে ভুল করে প্রেমে পড়া এক কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ সাড়া ফেলেন মোহনলাল। ছবিটি ১৯৮৪ সালের। প্রিয়দর্শনের সেই ছবির নাম ছিল ‘পুচাক্কারু মুক্কুর্থি’। এর মাধ্যমেই তৈরি হলো ইতিহাস। গড়ে উঠল মোহনলাম-প্রিয়দর্শন জুটি। আর এ জুটিকে মনে করা হয় ভারতের চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ব্যবসাসফল জুটি হিসেবে। তারা একসঙ্গে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৪টি ছবিতে কাজ করেছেন।
১৯৮৫ সালে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন মোহনলাল। এরপর আরও অনেক ছবির গানে কণ্ঠ দেন তিনি।
১৯৮৬ থেকে ২০০০ সাল অর্থাৎ পরের দেড় দশক মোহনলালের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে ধরা হয়। এ সময় তিনি দক্ষিণের সেরা সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেন দারুণ সব ছবিতে। তারকা থেকে মহাতারকা হয়ে ওঠেন তিনি এই সময়েই।
পরের দেড় দশক (২০০১ থেকে ২০১৫) নানা চরিত্রে রূপদান করেন মোহনলাল। আর এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন নানা মাধ্যমে। থিয়েটার করেছেন তিনি, ব্যান্ড করেছেন। হেঁটেছেন সিনে ও টিভি মিডিয়ার সব কক্ষপথেই। এখনো থামেননি তিনি। একেবারেই অবসর নেবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। অনেক কিছুরই ‘গুডউইল অ্যাম্বাসাডর’ তিনি। ব্যবসা করেন রেস্তোরাঁর। এ পর্যন্ত ৩২৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করা মোহনলাল তার ডাক নাম ‘লালেত্তান’ দিয়েই মিডিয়ায় অধিক পরিচিত।
তার ঝুলিতে আছে পদ্মশ্রী-পদ্মভূষণ। জাতীয় বা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের তালিকা দিলে তা অনেক বড় হয়ে যাবে। আছে অসংখ্য রাজ্য সম্মান। আছে কলকাতা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট।
মোহনলালের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো তাকে কখনো খ্যাতির পেছনে দৌড়াতে হয়নি, খ্যাতিই তার পেছনে দৌড়েছে। দক্ষিণী সিনেমায় মোহনলাল একটি ইতিহাস, একটি প্রতিষ্ঠান। একটি সাধারণ চিত্রনাট্যের সিনেমাকেও তিনি তার অভিনয়গুণে করে তুলতে পারেন অনন্য। নামি পরিচালক রাম গোপাল ভার্মা বলেন, মোহনলালই ভারতের একমাত্র অভিনেতা যাকে দিয়ে সব চরিত্র করানোই সম্ভব।
তার সমসাময়িকদের কাছেও তিনি পরম আপন, প্রাতঃস্মরণীয়। মামুত্তি, রজনীকান্ত, কমল হাসান, চিরঞ্জিবি বা নাগার্জুনের মতো প্যান-ইন্ডিয়ান মহাতারকারা তাকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চান না। অমিতাভ বচ্চন তাকে তুলনা করেন আকাশের সঙ্গে। এ প্রজন্মের জোসেফ (থালাপাতি) বিজয়, প্রভাস, অজিত কুমার, মহেশ বাবু, ধানুশ, বিজয় সেতুপতি, রাম চরণ, এনটিআর জুনিয়র, যশ কিংবা আল্লু অর্জুনরা তাকে বলেন ‘ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি’। দক্ষিণী সিনেমার আরেক ইন্ডাস্ট্রি নন্দমুরি বালাকৃষ্ণ তাকে ডাকেন ‘দ্য মাস্টার’। এ রকম আরও অনেক তকমা নিয়ে সিনেদর্শকদের ক্রমাগত মোহগ্রস্ত করে চলেছেন মোহনলাল।