সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল মানসিক রোগে ভুগছেন

খুব বেশি মানুষের সামনে আসতে পারছেন না সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জনসম্মুখে আসতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি ৫ বা ১০ জনের বেশি মানুষের সামনে এলে কিংবা রাস্তায় বের হলে বা কোন জনসমাবেশে গেলে তাকে কেউ মেরে ফেরতে পারেন এমন আতঙ্কে ভুগছেন তিনি।

এজন্য প্রায় ছয় মাস ধরে মনোচিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়ার চেষ্টা করছেন ৭৪ বছরের সাবেক এই অর্থ মন্ত্রী। কিন্তু পরিবারের বাধায় বিশেষত তার স্ত্রী কাশমিরি কামাল এটা মানতে পারছেন না। তিনি মনে করেন এই মুহুর্তে মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার ঘটনা জানাজানি হলে মুস্তফা কামালের মানসিক অবস্থা আরো বেশি ভেঙ্গে পড়তে পারে। তবে তা এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি বলে জানিয়েছে তার পরিবারের একটি সূত্র।

পরিকল্পনা মন্ত্রী থাকাকালে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তার ভেতরে মৃত্যু ভয় ঢুকে পড়েছে ব্যাপক হারে। তার মানে হচ্ছে প্রায় ৫ বছরই তিনি অসুস্থ্য অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর পদে ছিলেন। এরপর করোনা মহামারীর সময় তিনি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তখন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ না থাকায় প্রথম ২০১৯ সালে প্রথম বাজেটটি সংসদে তিনি উপস্থাপনও করতে পারেননি।

এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে তিনি মোটামুটি ঘরবন্দী হয়ে পড়েন। অফিস আসেননি বছরের পর বছর। কর্মকর্তারা জরুরী প্রয়োজনে তার বসায় ফাইলপত্র নিয়ে যেতেন। আর অজরুরী কাজকর্ম করতেন অনলাইন। এমনকি সব ধরনের সভা-সেমিনারও অনলাইনে করতেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে থাকার শেষ সময়েও পার্চেজ মিটিংগুলো অনলাইনে করেছেন। সচিবালয় আসলেও এড়িয়ে চলতেন কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের। ধরতে গেলে তিনি জনসম্মুখে আসতেনই না।

মুস্তফা কামালের একটি পারিবারিক সূত্র জানায়, পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রখ্যাত মনোচিকিৎসক মোহিত কামালের কাছে কাউন্সিলিং করানো হবে সাবেক এই মনস্ত্রীকে। মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে এসেছেন। সেখানকার চিকিৎসকরাও তাকে মনোচিকিৎসার পররামর্শ দিয়েছেন। তাই অবশেষে মোহিত কামালের স্মরণাপন্ন হতে যাচ্ছেন মুস্তফা কামাল।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে জিতে এমপি হলেও মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন মুস্তফা কামাল। এতেও তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন। যার প্রভাবও রয়েছে। ফলে তিনি এখন ঘরের বাইরে বের হন না। পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো সাথে কথাও বলেন না। দেখাও করেন না। ধরতে গেলে ২৪ ঘন্টাই তিনি বাড়িতেই থাকছেন।

সূত্র জানায়, তার ঘুমেও সমস্যা রয়েছে। এজন্য ঠিকমত ঘুমাতেও পারেন না। শারীরিকভাবে যতটা না দুর্বল তার চেয়ে বেশি দুর্বল মানসিকভাবে। কারো সাথে কথা বলতে গেলে হাত পা এমনকি শরীর মুখমন্ডল কাপে। এছাড়া আলোচনা বা কথার বিষয় বিষয়ও ভুলে যাচ্ছেন। কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন সেটাও একটু পর পর ভুলে যাছেন। অতীতের স্মৃতি মনে থাকলেও শর্টাটাইম মেমরি ঠিকঠাক কাজ করছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমি সাবেক অর্থমন্ত্রীর সুস্থতা কামনা করি। তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন । যদি তিনি অনেক আগেই অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে যখন থেকে এমন হতে শুরু করেছে তখন থেকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে অন্য কাউকে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো অর্থনীতির অবস্থাটা এতটা খারাপ হত না। তবে সেটা তো সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারের ওপর নির্ভর করে। গত পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ সংকটে ফেলে গেছেন অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। এই সময়ে তিনি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা তো দূরে থাকুক মন্ত্রনালয়ে পর্যন্ত যাননি। সংকট সমাধানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বৈঠকও করেননি। অর্থনীতির সংকটগুলোকে চিহ্নিতও করতে পারেননি এ সময়ে। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছর অর্থনীতির পুরোটাই ব্যর্থতার ইতিহাস। তার সময়ে ব্যাংক খাতে ভয়াবহভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক থেকে দেদারছে বেরিয়ে গেছে জনগনের অর্থ। এমন কি পরিচালকরা যোগসাজশ করে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেছেন অবাধে। এতেও অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কোন প্রকার পদক্ষেপ নেননি মুস্তফা কামাল।

মুস্তফা কামালের ৫ বছরে ডলার সংকট ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আকার নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। পণ্যমুল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সামগ্রিক আর্থিক খাতেও বেড়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। এ সময়ে কয়েক গুণ বেড়েছে অর্থ পাচার। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তাদের মাঝে আস্থা ফেরাতেও কোন রকম পদক্ষেপ নিতে পারেননি লোটাস কামাল। অর্থনৈতিক সংকট সমাধান তো দূরের কথা সংকটের কারণগুলো পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেননি তিনি।

এদিকে মন্ত্রনালয়ের কাজে না গেলেও ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে সময় দিতে কার্পণ্য করেননি মোটেও। জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানীর প্রথমবার যে ১০ টি সিন্ডিকেট চিহ্নিত হয়েছিল তার একটি আ হ ম মুস্তফা কামালের শ্যালক আরিফ হোসেনের। প্যাসেস নামের এই প্রতিষ্ঠান মূলত ছিল মুস্তফা কামালের নিজস্ব কোম্পানি। সে সময় তিনি পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। আইনগত বাধা দূর করার জন্য শ্যালকের নাম দিয়ে রেখেছেন কাগজে-কলমে। একইভাবে অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানীর সিন্ডিকেটের দুটি লাইসেন্স তার স্ত্রী কাশমিরি কামাল ও কন্যা নাফিসা কামালের নামে করেন। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল ও অরবিটাল এন্টারপ্রাইজ। এর বাইরে রেয়েছে অরবিটাল মেডিক্যাল সেন্টার ও গুলশান মেডিকেয়ার লিমিটেড।

Exit mobile version