গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দৃশ্যের অবতারণা ঘটাতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির সঙ্গে একই দিনে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে তারা। ৬৩টি রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে একতরফা ও পাতানো নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে বিরোধীরা। অপর দিকে নির্বাচনের বৈধতা আদায়ে দেশি-বিদেশি শক্তিকে পক্ষে আনতে বেশ তৎপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে দেশি-বিদেশি সব পক্ষের সমর্থন যোগাতে পারছে না কার্যত বিরোধী দল শূন্য শেখ হাসিনার সরকার।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরব হতে শুরু করেছে বিরোধী পক্ষ। অপর দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিরোধী পক্ষের এসব কর্মসূচিকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে একই দিনে পূনরায় কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে মাস না পার হতেই রাজপথে ফের রাজনৈতিক উত্তাপের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখনই বিরোধী দলের কর্মসূচিকে চ্যালেঞ্জ করে আওয়ামী লীগের এমন কর্মসূচি অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাণহানিরও আশঙ্কা করছেন তারা।
ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ মনে করেন, শাসক দলের উচিৎ বিরোধী দলগুলোকে স্পেস দেওয়া। বিগত বহুদিন ধরেই বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যত আন্দোলনই করেছে, সবগুলোই শান্তিপূর্ণই করেছে। আর যদি অশান্তি সৃষ্টি করে, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। শান্তি রক্ষা বা শৃঙ্খলা রক্ষা কোনো রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। বিরোধী দল কোনো বিঙ্খখলা করলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, সুযোগও আছে।
তিনি বলেন, বিরোধী পক্ষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিলের দাবি করতেই পারে। এটা তাদের অধিকার। আমরা দেখেছি, বিরোধী দলের কর্মসূচির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা যখনই কোনো কর্মসূচি দিয়েছে, তখনই সংঘর্ষ হয়েছে। শান্তি ভঙ্গ হয়েছে। এখনো শান্তি সমাবেশের নামে কোনো কর্মসূচি দিলে, তাতেও শান্তি ভঙ্গের সম্ভাবনা দেখছেন শারমিন মুরশিদ।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সারা দেশে সমাবেশ করেছে। বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। বরং বিভাগীয় সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং শাসক দলের লোকজন নানাভাবে হয়রানি এবং বাধা দিয়েছে। এরপরও বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবেই সারাদেশের সমাবেশগুলো সম্পন্ন করেছে। কোনো পাল্টা আঘাত বা আক্রমণ করেনি। কিন্তু ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ ডিসেম্বর দলটির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা চালায়। ব্যাপক সংঘর্ষ হয় সেখানে। জাতীয় নির্বাহী কমিটিসহ সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের অন্তত সাড়ে ৬’শ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ-ডিবি। পরে গভীর রাতে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির মির্জা আব্বাসকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। প্রায় তিন মাস পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে, বিএনপি আবারো শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
২০২৩ সালের জুন মাসের পর বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকানোর নয়া কৌশল নিয়ে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি কোনো সভা সমাবেশ আহ্বান করলেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী, অঙ্গ সংগঠনও শান্তি সমাবেশের ডাক দেওয়া শুরু করে। এসব সমাবেশের স্থানও বিএনপির সমাবেশ স্থলের আশপাশে বা কোথাও কোথাও দেখা গেছে একই স্থানে। শুরু হয় রাজনৈতিক নতুন সংঘাতময় অধ্যায়। গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের বিএনপির সমাবেশকে প্রতিহত করতে একই দিন একই সময়ে বাইতুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। দুই পক্ষের সমাবেশ চলাকালেই শুরু হয় সংঘর্ষ। যদিও বিএনপি সমাবেশে সংঘর্ষের সূত্রপাত মূলত, আওয়ামী লীগ দলীয় গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থক ও কিছু পুলিশ কর্মকর্তার অতি উৎসাহের কারণেই বলে বহু অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগের এসব সমাবেশে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি তেমন একটা না হলেও, বিএনপি এ ক্ষেত্রে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। তাদের সবগুলো সমাবেশেই ছিলো বিপুল জনসমাগম। এ কারণেই কৌশলে বিএনপির এই আন্দোলনকে বিতর্কিত এবং ছত্রভঙ্গ করে রাস্তা থেকে তুলে দিতেই এক প্রকার পায়ে পারা দিয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বাইরে রাখারও কৌশল হিসেবে এ কাজ করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম শাখাওয়াত হোসেন মনে করছেন, আবারও একই পথে হাঁটছে ক্ষমতাসীনরা। যে কোনো ভাবেই তো আওয়ামী লীগ নির্বাচন তুলে নিয়েছে। সরকারও গঠন করে ফেলেছে। এখন আবারো বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগকে কেন শান্তি কর্মসূচি দিতে হবে। দেশে কী কোনো শান্তি বিঘ্ন ঘটেছে?
তিনি মনে করছেন, এমন মুখোমুখী কর্মসূচি পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলবে। আবারো মারামারি হবে। একটা অস্থিরতা তৈরি হবে। সরকারকে নমনীয় হতেই হবে। না হলে পরিস্থিতি ভিন্ন পথে চলে যাবে।
এ সব বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাথে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যদি কোনো নৈতিকতা থাকে, নূন্যতম দেশপ্রেম থাকে, তাহলে পদত্যাগ করে, একটি নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের মাধ্যমে প্রকৃত নির্বাচন দেয়া। আর বিএনপির উচিত প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন না করে, প্রকৃত জন আন্দোলন করা। জনগণের কাছে তাদেরও পরিষ্কার করতে হবে, তারা আসলেই এই সরকারের বিরোধিতা করছে না পরিবর্তনের লক্ষেই আন্দোলন করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রাজনীতিতে খেলা খাকবেই। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও থাকবে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে “জনসমর্থন”। এই কালো পতাকা বা সাদা পতাকা মিছিল-সমাবেশ, কোনো ফল এনে দেবে না। সবই ব্যর্থ হবে।
তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিএনপি একভাবে মূল্যায়ণ করছে। আর আওয়ামী লীগ আর একভাবে মূল্যায়ণ করছে। প্রকৃতপক্ষে জনগণ কীভাবে মূল্যায়ণ করছে, সেই বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরী। আর এমন কর্মসূচিতে রেজিম পরিবর্তন হয়নি কখনো, এখনো হবে না। সমগ্র বাংলাদেশ উত্তাল করতে হবে। না হলে যেটা হবে, তা হচ্ছে, পাল্টাপাল্টি মিডিয়া কাভারেজ। আলোচনায় থাকা। আর কিছুই হবে না।