ইতিহাস-ঐতিহ্য

দেশের সর্ববৃহৎ সরোজগঞ্জ গুড়ের হাট ৩০০ বছরের পুরোনো

জমে উঠেছে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের কয়েকশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট। শীতের এই সময়ে গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন পাইকাররা।

বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। দিনদিন বেড়েছে এই গুড়ের হাটের চাহিদা। কিন্তু সরবরাহ কম হওয়ায় বাইরের জেলা থেকে এসে পর্যাপ্ত গুড় না পেয়ে হাট থেকে ফিরে যাচ্ছেন বেপারীরা।

কৃষি বিভাগসূত্রে জানা যায় , দিনদিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গুড় উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে। গুড়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খেজুর গাছ লাগাতে উৎসাহী করা হচ্ছে।

সরজমিনে হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটের চারপাশে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাক ডাকে মুখর হয় এই খেজুর গুড়ের হাট। সপ্তাহের দু-দিন শুক্রবার ও সোমবারে খেজুর গুড়ের হাট বসে। এই হাটে এবার খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। কৃষকরা তাদের খেজুর গাছ কেটে ফেলছে। আবার অনেক খেজুর গাছের বয়স হয়ে যাওয়া তা থেকে রস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গাছের সংখ্যা যেমন কমে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি দেশে খেজুর গুড়ের সরবরাহ কমে যাচ্ছে।

এদিকে জেলার কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গুড়ের চাহিদা পূরণে গাছ বৃদ্ধি করে দেশে গুড়ের ঘাটতি কমানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ায়। একই সঙ্গে গুড়ের চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক রাখা যায়।

হাট সূত্রে জানা গেছে, এই ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জের গুড়ের হাটে প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হয় ২০০- ২৫০ টাকা করে। প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। প্রতিবছর এই হাট থেকে বেচাকেনার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। এই হাটের গুড় দেশের জেলাগুলোর মধ্যে ঢাকা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, পঞ্চগড়, সিলেট, খুলনা, রংপুর, রাজশাহীসহ আরও অন্যান্য জেলায় এই গুড় সরবরাহ এবং বিক্রেতারাও এই হাটে গুড় কিনতে আসেন। এই হাটে গুড় বেচাকেনা করে কৃষক ও হাটমালিকরাও লাভবান হয়। এছাড়া চিনির দাম বাড়াই এবার বলতে গেলে শতভাগ গুড় নির্ভেজাল।

নাম প্রকাশ করে এক গুড় প্রস্তুতকারী চাষি বলেন, গুড়ে চিনি মিশাবো কিভাবে, চিনির যে দাম। চিনি মিশালে উল্টো লস হবে।

জিল্লুর রহমান নামের এক গুড় ব্যবসায়ী বলেন, গুড়ের দাম বেড়েছে। এখন প্রতি ভাড় (গুড় রাখার পাত্র) গুড় চব্বিশ-পচিশ শ’ টাকা। তবে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় গুড়ে ভেজাল বন্ধ হয়েছে। আমাদের এই হাটের ঝোলা গুড়-নলেন পাটালি সারা দেশেই বিখ্যাত। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার হাটে চাহিদা বেশি। তবে সরবরাহ অনেক কম। বাইরের ব্যাপারীরা অনেকেই ইচ্ছামতো গুড় কিনতে পারছেন না।

পাবনা থেকে আসা শহিদুল ইসলাম নামের এক গুড়ের ব্যাপারী বলেন, এবার গুড়ের দামও বেশি এবং সরবরাহ কম। তবে গুড়ে ভেজাল নেই। এছাড়া এই হাটে আসলে আমরা ব্যাপারীরা বেশ নিরাপত্তাও পাই। কিন্তু ইচ্ছামতো গুড় কিনতে পারছি না। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার চুয়াডাঙ্গা সদরে ৯৮ হাজার ৫০০টি গাছ। আলমডাঙ্গায় ৪৫ হাজার ৫১০টি গাছ, দামুড়হুদায় নয় হাজার ২০০টি গাছ, জীবননগরে ৩৭ হাজার ৪৫০টি গাছ। এবার মোট দুই লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টি খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে এবার গুড়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এই লক্ষ্যমাত্রা গুড়ের বিক্রির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতিবার এই গাছ প্রস্তুতে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৩০ হাজার কৃষকের।

রাজবাড়ী থেকে আসা এক ক্রেতা বলেন, এবার এই গুড়ের হাটে চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু তুলনামূলক সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে পর্যাপ্ত গুড় না পেয়ে আমরা হাট থেকে ফিরে যাচ্ছি। খেজুর গাছের সংখ্যা এবার কমে গেছে। তাই গুড়ের চাহিদার আলোকে সরবরাহ হচ্ছে না।

স্থানীয় গুড় ব্যবসায়ী উজ্জ্বল কুমার অধিকারী বলেন, আমাদের এই গুড়টা সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পাবনা ও ঢাকাসহ সারা দেশে যায়। বাপ-দাদার মুখে শুনে আসছি এটা তিনশ’ বছরের পুরোনো দেশের সর্ববৃহৎ হাট। আর আমাদের এই হাটের গুড়-পাটালির খুব চাহিদা আছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের গুড় ব্যবসায়ী বাবুল বলেন, এই হাট তিনশ’ বছরের আগের হাট। এই হাটে খাটি গুড় পাওয়া যায়। এখানকার গুড়ে কোনো ভেজাল নেই। বহু জায়গা থেকে ব্যাপারী আসে এখানে।

সামসুল মিয়া নামের একজন চাষি বলেন, গত বছর ২৫টি গাছ প্রস্তুত ছিল তার। এবার সে সংখ্যা মাত্র ১২টি গাছ প্রস্তুত হয়েছে। এই গাছ থেকে যেটুকু রস পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়েই গুড় তৈরি করা হচ্ছে। পরে তা হাটে তোলা হয়েছে। দামও এবার ভালো।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের গুড় প্রস্তুতকারক চাষী আসাদুল বলেন,গাছ কাটার হিসেবে তুলনামূলক যে খাটনি সেই খাটনির মজুরি হয় না। সে হিসেবে ২৫০থেকে ৩০০ টাকা কেজি বেচলে আমরা মজুরিটা পেতাম, কিন্তু তাতো আমরা পাইনে। আমরা পাইকারি দেড়শ’ থেকে খুচরা ২০০ টাকা পর্যন্ত পাই। তাতে আমাদের খড়ি পোড়ানো ও খাটনির মজুরি হয় না। আবার একটা মাটির ভার কিনতে হয় ১০০ টাকা দিয়ে সে হিসেবে গুড় তৈরি করে হাটে এনে লাভ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

পাইকারি গুড় কিনতে ঢাকা কেরাণীগঞ্জ থেকে হাটে আাসা প্রবির সাহা বলেন, আমি এসেছি ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থেকে। চুয়াডাঙ্গা সরোজগঞ্জ যে গুড়ের হাটের গুড়ের মান খুব ভালো। আমাদের ঢাকাতে এইসব গুড়ের অনেক চাহিদা। এখানকার কিছু কিছু গৃহস্থ আছে এদের গুড়ের মানটা এত ভালো। এখানকার গুড় ঢাকায় নিয়ে যেয়ে অনেক লাভ করা যায়। এখানকার গুড়ের ভালো চাহিদা আছে। তাই ঢাকা থেকে এত দূরে গুড় নিতে এসেছি।

পাবনা থেকে আসা কয়েকজন ব্যাপারী জানান, প্রতি সপ্তাহে তারা আসেন। এখন তারা এখান থেকে গড়ে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে গুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই গুড় বেশ ভালো লাভে বিক্রি করে থাকেন।

অন্যতম হাট পরিচালনাকারী নিলুয়ার বলেন, এই পরিচালনা আমরা করি। সপ্তাহে দুদিন এই হাট বসে। বাইরে থেকে যে ব্যাপারীরা আসেন আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। এই হাটের সুনাম আছে সারাদেশে। এখানে এক দেড় কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়।

এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট জমে উঠেছে। সপ্তাহের দু-দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই হাটে খেজুরের গুড় বেচাকেনা হয়। তবে এবার জানা গেছে যে হাটে গুড়ের চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। সরবরাহ বাড়ানোর জন্য খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জেলার কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা গুড়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button