আওয়ামী লীগরাজনীতি

দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে না আওয়ামী লীগ, কেনো?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে পরিচিত আসন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বর্তমানে সকল নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট করার বিধান থাকলেও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমীকরণে আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ বলে মনে করা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকারের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে থাকছেনা এবার কোন প্রতীক। এদিকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান সহ তিন পদেই দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিধান রয়েছে।

প্রাথমিকভাবে নানা আলোচনা সমালোচনার মুখে আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এর আট বছর পর সেই আওয়ামী লীগই দলীয় প্রতীকের অধীনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে এই ভোটের মাঠের চিত্র হবে অনেকটা ভিন্ন। দলীয় নৌকা প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ায় যাঁর যাঁর মতো করে স্বতন্ত্রভাবে দলের নেতারা নির্বাচন করতে পারবেন। যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতাদের ভোট চাইতেও নেই কোন বাঁধা।

দলীয় সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি করে আসছে কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা বড় অংশ। সোমবার (২২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের জরুরি কার্যনির্বাহী সভায় প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, মার্কা না দিলেই যে গণ্ডগোল হবে না, তা নয়। দেখ তোমরা কী করবা, মার্কা দিও না। আমি মনোনয়ন দেবো না, আমারও ঝামেলা কমে গেলো।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আপাতত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এতে ভোট উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক হবে। যিনি জনপ্রিয় প্রার্থী তিনিই জয়ী হয়ে আসবেন। বিষয়টি নিয়ে দলের মনোনয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আমরা দলের প্রতীকের প্রার্থিতা দেব কি না, এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সর্বসম্মত অভিমত যে, এবার উপজেলা নির্বাচনে আমাদের দলীয় প্রতীক নৌকা ব্যবহার না করা। নৌকা না দেওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সবাই অভিমত পেশ করছেন।

তিনি আরও বলেন, আপাতত এটা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত। ওয়ার্কিং কমিটি যেটা সিদ্ধান্ত নেয়, মনোনয়ন বোর্ড সেই সিদ্ধান্ত বহাল করে। মনোনয়ন বোর্ডের আনুষ্ঠানিকতার আগে বিষয়টা নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।

বৈঠকে থাকা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতারাই উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না করার পক্ষে রায় দেন এবং সকলের রায়ের ভিত্তিতেই দলের সভাপতিও সম্মতি জানান।

* কেন থাকছে না দলীয় প্রতীক?

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতীক ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের এই সিদ্ধান্তের জন্য বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পূর্বে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তিরা দলীয় প্রতীক ছাড়াই চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু প্রতীক বরাদ্দের কারণে নির্বাচনটি দলীয় নির্বাচনে পরিণত হয়। এবার সেই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে চায় আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে যে কারণগুলো সকলেই জানিয়েছেন তা হলো-

১. দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা রোধ:

দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা ঠেকাতে স্থানীয় সরকারে দলীয় মার্কা না দেওয়ার অভিমত দেন নেতারা। দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় তৃণমূলে বিভেদ তৈরি হয়েছে এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিলে অন্যরা স্বতন্ত্র ভোট করবে। এতে বিভেদ আরও বাড়বে। তাই উন্মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত।

২. ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো:

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল বিরোধীদের ভোট বর্জন ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন। তাই ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করতে হলে দলীয় মনোনয়ন বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত।

৩. প্রার্থীদের রাজনৈতিক অবস্থান ও দক্ষতা যাচাই:

জনপ্রিয়তা সাধারণ ভোটারদের সাথে সখ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণের লক্ষ্যে বরাদ্দ হয়নি দলীয় প্রতীক।

৪. অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক নির্বাচন:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিলেও দলের অনেকেই স্বতন্ত্রভাবে হয়েছেন প্রার্থী। এতে দেশের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২৫টির মতো আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ৬২ জন নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দলীয় প্রতীক দিলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই ধারা বজায় থাকবে বলেও ধারনা করা হচ্ছে ফলে প্রতীক থেকে অনেকটাই দূরে আওয়ামী লীগ।

৫. নির্বাচনী সহিংসতা তৃনমূলে বিভক্তি এড়ানো:

২০১৫ সালে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালুর পর থেকে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এসব দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও সহিংসতা ঠেকাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

* দলীয় প্রতীক না দেয়া কি নির্বাচনী কৌশলগত সিদ্ধান্ত?

দলের এমন সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছাড় দেয়ার বিষয়টিও ছিলো ক্ষমতাসীন দলের কৌশল।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলীয় সংহতি, ঐক্যের বিষয় চিন্তা করে এবার উপজেলা নির্বাচনে কাউকে নৌকা না দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় হয়েছে। তবেই এটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রতীক বরাদ্দ পুনর্বহাল হতে পারে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বলছে, দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার পর কেউ এর বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে বা অন্য কারও পক্ষে নির্বাচনে কাজ করলে তাঁকে দল থেকে সরাসরি বহিষ্কারাদেশ রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের পর সব ধরনের নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বহিষ্কার করা হলেও এবার জাতীয় নির্বাচনে গঠনতন্ত্রের এই ধারার প্রয়োগ করা হয়নি। দলের সিদ্ধান্ত নিয়েই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতারা।

* ব্যালট না ইভিএম

এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। জানা যায়, চার থেকে পাঁচ ধাপে এ নির্বাচন হবে। যেসব স্থানে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন সচল আছে সেখানে ইভিএমেই ভোট হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান।

* মন্ত্রী- এমপিদের প্রচারে বাধ্যবাধকতা:

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এবার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রচারের সুযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে খুবই কম। কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রচারণায় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্রচারণায় তৃণমূলের রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এতে তৃণমূলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। আসতে পারে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ।

২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হয় দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। আর প্রথমবার দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিরোধী দল সহ সমমনা দলগুলো।

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, প্রথম ধাপে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন, এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে এবং ১২ মার্চ শেষ হবে। আবার ১০ বা ১১ মার্চ রোজা শুরু হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপে যেই নির্বাচনগুলো করতে হবে, সেগুলো ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কিছু হবে। বাকিগুলো কয়েকটা ধাপে মে মাসে করা হবে। কারণ জুন মাসে আবার এইচএসসি পরীক্ষা।

ইসি জানান, আগামী ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। উপনির্বাচন ও মহিলা সংরক্ষিত আসনের তফসিল শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।

দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, সর্বশেষ নির্বাচনে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম ভোট পড়েছে। অতীতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ।

২ মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button