বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে হতাশ সাধারণ মানুষ

সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ হতাশ। দলের মধ্যেও এক ধরনে হতাশা দেখা দিয়েছে। লিফলেট বিতরণ, কালো পতাকা মিছিল, ঘরোয়া আলোচনা সভা-সেমিনার এবং জেলা-মহানগরে দিবস ভিত্তিক নিয়মরক্ষার কর্মসূচি ভালভাবে নিচ্ছে না সাধারণ মানুষ। দলটির নেতা-কর্মীরাও মনে করছেন আন্দোলনের এই ধরনে সরকারকে নাড়ানো যাবে না।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত চরম দুর্বল হয়ে পড়েছ। বিতর্কিত ডামি নির্বাচনের পর হাসিনা সরকার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও বেশ বেকায়দায় রয়েছে। ফলে বিরোধী পক্ষ এখনই শক্ত প্রতিরোধ বা আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে, অল্প সময়ের মধ্যে সব কিছু সামলিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে চলে যাবে আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে জনগণও সরকারের সকল অন্যায়-অনিয়ম মেনে নিতে এক প্রকার বাধ্যই হবে। আর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কর্মীহারা হতে শুরু করবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের মতামত পাওয়া গেল।

রাজধানী ঢাকার বাংলামোটর এলাকার জহুরা স্কায়ার মার্কেটের ব্যবসায়ী নাদিম সাহেব বেশ রাজনীতি সচেতন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। দীর্ঘ ক্ষমতার মেয়াদে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে; সাধারণ মানুষের সাথে দলটির সম্পর্কেও ভাটা পড়েছে বলে মন্তব্য করেন টাইলস ব্যবসায়ী নাদিম সাহেব। তিনি বলেন, বিরোধী পক্ষ এটিকে পুঁজি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এত জনসমর্থনের পরও শুধু কর্মসূচির ধরনের কারণে মার খাচ্ছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। এমন হালকা কর্মসূচি দিয়ে আর যা হোক, আওয়ামী লীগকে দুর্বল করা যাবে না। সময়ক্ষেপণ না করে শক্ত কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির মাঠে নামা উচিৎ বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নাদিম সাহেব।

প্রায় একই মন্তব্য গুলশান ৬ নম্বর সড়কের বাসিন্দা আজগর আলী চৌধুরীর। পেশাদার নির্মাণ ঠিকাদার আজগর আলীর মন্তব্য, বিএনপি বিদেশীদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে আন্দোলনের পথ থেকে সরে গেছে। বিদেশী বন্ধুরা কী তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? উন্নত দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেন বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে? তারা একটা পরিস্থিতি তৈরি করে দিতে পারে। বাকি কাজ তো বিএনপিকেই করতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারের ধরন এমনই হয়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যে ধরনের জনসমর্থন দরকার হয়, বিএনপি তার চেয়ে বেশি জনসমর্থন এই মুহূর্তে পেয়েছে। কিন্তু তারা হঠাৎ আন্দোলনের কৌশল বদলের নামে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছে। জনগণ ঠিকই সরকারের নির্যাতনে সব সহ্য করে চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। তাদের জেল হয়ে যাবে। কর্মীরা কৌশলে নিজেদেরকে সরিয়ে নেবে।

তিনি মনে করেন, নানা কৌশলে বিএনপিকে শক্ত কর্মসূচি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। হতে পারে দলের ভেতরে একটি অংশ সরকার ও ভারতের সঙ্গে যোগসাজশ করে এমনটা করছে। আমরা মাঝারি শক্তির বিএনপিকে মাঠে দেখতে পাচ্ছি। এরা কিছু কিছু কর্মসূচি করছে। ৫/৭ লাখ মানুষ নিয়ে সমাবেশ করছে। কিন্তু ক্ষমতা পরিবর্তনের মতো শক্তি দেখাতে পারছে না। এই রকম দুর্বল শক্তির বিএনপিকে ইচ্ছা করেই আওয়ামী লীগ ও ভারত টিকিয়ে রেখেছে। এতে করে আওয়ামী লীগেরই লাভ হচ্ছে। এই বিএনপি ক্ষমতার পরিবর্তন করতে পারছে না। আবার বিএনপি রাজনীতির মাঠে টিম টিম করে সক্রিয় থাকার কারণে বিকল্প নতুন শক্তিও দাঁড়াতে পারছে না।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক বলেন, বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলনে এবারের মতো এমন জনসমর্থন আর কখনো ছিল না। আমাদের যুগপৎ ধারার প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণের সঙ্গে আমাদেরও প্রত্যাশা ছিল ৭ জানুয়ারির পর কঠোর কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে। কিন্তু তা হলো না। এতে বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলের কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে; সাধারণ মানুষও নিরাশ হয়েছে। লিফলেট বিতরণ, কালো পতাকা মিছিল বা দিবস ভিত্তিক কর্মসূচিতে মানুষের বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, এমন সুযোগ বিএনপি আর পাবে না। বিদেশীরা প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে দিতে পারে। কিন্তু বাকি কাজ তো আমাদের করা উচিৎ ছিল। এরপরেও তিনি বিশ্বাস রাখেন, বিএনপি বাস্তবতা, সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা ও দলের কর্মীদের কথা বিবেচনা করে কর্মসূচি জোরদার করবে।

সাইফুল হক বলেন, ৭ জানুয়ারির আগেও দুই দফা সারা দেশ থেকে দলের পাঁচ-সাত লাখ নেতা-কর্মীকে ঢাকায় এনে তাদের নিরাশ করা হয়েছে। মানুষের মনোবল একবার ভেঙ্গে গেলে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সময় লেগে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ফেরে না।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের দ্বায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, “৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনের কর্মসূচি সফল করেছে সাধারণ জনগণ। কিন্তু দলের অধিকাংশ নেতাই মাঠে নামেনি। বিশেষ করে ঢাকার অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ।”

এমন পরিস্থিতির জন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে সহযোগী, অংগ সংগঠনগুলোর পূর্ণাঙ্গ শাখা কমিটি না হওয়া এবং যোগ্যদের মূল্যায়ন না করাকে দুষছেন।

তিনি বলেন, “বিএনপি এবারের আন্দোলনে যে জনসমর্থন পেয়েছে, এই সমর্থন ধরে রেখে আমরা যদি সফল হতে না পারি তাহলে আমাদের যারা বড় বড় নেতা আছেন, তাদেরও রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। কারণ হিসেবে তিনি নিজের উদাহরণ টেনে বলেন, এই মুহূর্তে আমার বিরুদ্ধে ১’শ ৭৮ টি মামলা চলছে। এর মধ্যে ১০টিতে দণ্ড হয়ে গেলে, সারা জীবন জেলে থাকতে হবে। আবার আন্দোলন গুছিয়ে ওঠার জন্য বেশি সময় নিলে, আমাদের দুইটি প্রজন্মের রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যাবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে, আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সাথেও আলোচনা হয়েছে। কর্মীদের হতাশার বিষয়ে আমরাও অবগত। আলোচনা হয়েছে। শক্ত কর্মসূচিই আসছে। আমরা জিতবই।

বিএনপির ‌‘দ্রুত’ ও ‘শক্ত’ এই শব্দগুলো নিয়মরক্ষার জন্য বলা হচ্ছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করেছি। সব ঠিকঠাক করে আমরা নেমে পড়ছি।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, বিএনপিসহ যুগপৎ ধারার আন্দোলনের শরিক দলগুলোর আন্দোলনের দুর্বলতা এবং নেতা-কর্মীদের হতাশাসহ সব দিক নিয়ে আমাদের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও আমরা এসব বিষয় অবহিত করেছি। এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে। আন্দোলনকে পুনরায় জোরদার করে জনসম্পৃক্ত গণআন্দোলনে রূপ দিতে কী কী করণীয় তা নির্ধারিত হয়ে গেছে।

তবে, আন্দোলনরত দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতার মধ্যে সহযোগী, অংগ সংগঠনগুলোর বিভিন্ন ইউনিটে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা, নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা মেনে নিয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, মানুষ আন্দোলনে সমর্থন দেয়, কিন্তু মাঠে তো নামতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে। অগোছালোভাবে মাঠে না নেমে, প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামা প্রয়োজন। সে জন্য হয়তো কিছুটা সময় লাগতেই পারে। এতে হতাশার কোনো কারণ নেই।

Exit mobile version