‘রাম মন্দির’ মোদির আবারো ক্ষমতায় আসার ট্রামকার্ড
ভারতের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার ৩ যুগ পর সেখানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করছে মোদি সরকার। দেশটির আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে আজ অযোধ্যায় এক জমকালো আয়োজনে এ মন্দিরটি উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মসজিদের স্থানে মন্দির উদ্বোধনের আয়োজনকে দেশটির বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখছেন।
তারা বলছেন, নরেন্দ্র মোদি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করছেন। যে কারণে মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় দেবতা রামের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে। মোদি ভারতের সবচেয়ে পরিণত নেতাদের একজন হয়েও একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং মোদির ওপর একটি বইয়ের লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, “শুরু থেকেই মোদি ইতিহাসে তার স্থান চিহ্নিত করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী তিনি রাজনীতির পথে হেঁটেছেন। মসজিদের স্থলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেটি নিশ্চিত করেছেন তিনি।
অনেকেই মন্দিরের উদ্বোধনকে মোদির নির্বাচনী প্রচারণার সূচনা হিসাবে দেখছেন। কেননা তিনি একজন স্বীকৃত জাতীয়তাবাদী যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দু আধিপত্যকে সমর্থন করার জন্য ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত। এর মাধ্যমে তার দল বিজেপি চলতি বছরের এপ্রিল বা মে মাসের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক লাভের জন্য আবারও ধর্মকে কাজে লাগাবে এবং টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নিশ্চিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এটি ক্ষমতাসীন দলের একটি জাতীয় আয়োজন। ভারতের ছোট্ট শহর অযোধ্যায় এই মন্দিরের উদ্বোধনের মাধ্যমে হিন্দু ভোটারদের সাথে দলটির মেলবন্ধন আরো গভীর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মোদির সমর্থকদের অনেকেই তাকে ভারতে হিন্দু গৌরব ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের অবতার হিসেবে দেখে থাকেন। যেখানে মুসলমানরা জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশের কিছু বেশি।
নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, “অযোধ্যায় যা করা হচ্ছে এবং এই মুহূর্তে এটি যেভাবে নির্মিত হচ্ছে তা আসলে হিন্দু ভ্যাটিকানের মতো দেখাবে এবং এটিই প্রচারিত হতে চলেছে।”
তার মতে, ‘‘মন্দির তৈরির কৃতিত্ব বিক্রি করার চেষ্টা করার একটি সুযোগও হারাবেন না মোদি।”
রাম মন্দিরটির আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় ২১৭ মিলিয়ন ডলার। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, ভগবান রাম ঠিক সেই স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে মুঘল মুসলমানরা ষোলো শতকে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপরে বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে উগ্রবাদী হিন্দুরা বাবরি মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয়। সে সময় দেশব্যাপী দাঙ্গা শুরু হলে ২ হাজারের বেশি লোককে হত্যা করা হয়। যাদের বেশিরভাগই ছিলো মুসলমান। মূলত এর পর থেকেই ভারতের রাজনীতিতে নতুন পরিচয় যোগ হয়। আর এর ওপর ভর করেই ১৯৮০ দশকে দুটি সংসদীয় আসন পাওয়া মোদির দল বিজেপি এখন ভারতে রাজ করছে।
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের একজন স্বল্প পরিচিত স্থানীয় নেতা। সে সময় তিনি হিন্দুদের মধ্যে বাবরি মসজিদ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। সে সময় তার লক্ষ্য ছিল বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য সমর্থন জোগাড় করা।
বাবরি মসজিদ পুনরুদ্ধারের জন্য মুসলিম দলগুলো কয়েক দশক ধরে আদালতে লড়াই চালায়। বিরোধটি ২০১৯ সালে শেষ হয়েছিল। একটি বিতর্কিত রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের ধ্বংসকে “আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করেছিল। যদিও জায়গাটি হিন্দুদের বলে রায় দিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসলিমদের অন্য এলাকায় একটি আলাদা জমি মঞ্জুর করা হয়।
এতে অনেক মুসলমান ব্যথিত-বিক্ষুদ্ধ হন। আদালতের সেই রায় তাদের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। কেউ কেউ বলেন যে, মন্দিরটি এখন হিন্দু আধিপত্যের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রমাণ।
‘হিন্দু ভারতে মুসলিম হওয়া’ বইয়ের লেখক ড. জিয়া উস সালাম বলেন, “একটি ভয় আছে যে এই সরকার এবং তাদের সহযোগীরা দেশ থেকে মুসলিম বা ইসলামিক সভ্যতার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে চায়।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা ভারতীয় মুসলমানরা ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং উত্তর ভারতের অন্তত তিনটি ঐতিহাসিক মসজিদ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দাবির কারণে আদালতের মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। হিন্দুরা বলছে যে, মসজিদগুলো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হয়েছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শত শত ঐতিহাসিক মসজিদের মালিকানা চেয়ে ভারতীয় আদালতে অসংখ্য মামলাও করেছে।
ড. সালাম বলেন, “একদিকে, তারা মুসলিম শব্দযুক্ত সমস্ত শহরের নাম পরিবর্তন করতে চায়। অন্যদিকে, তারা কার্যত প্রতিটি মসজিদ থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং আদালত যে কোনও অজুহাতে আবেদন গ্রহণ করতে পেরে খুশি।”
বিতর্কিত স্থানে মন্দির পুনর্নির্মাণ করা কয়েক দশক ধরে বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের অংশ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের তরঙ্গে ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। ২০২০ সালের গ্রাউন্ডব্রেকিং অনুষ্ঠানে যোগদানের পরে সেই প্রতিশ্রুতির তত্ত্বাবধান করছিলেন।
এদিকে মন্দিরটি উদ্বোধনের সময় সমর্থকদের বাড়ি ও স্থানীয় মন্দিরগুলিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা দেশে এটি উদযাপন করতে বলা হয়েছে। কেননা তাদের বিশ্বাস মন্দিরটি “সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক ঐক্যের” প্রতীক হবে। মোদি সরকার কর্মচারীদের উদযাপনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার জন্য সোমবার সমস্ত অফিস অর্ধ-দিবস বন্ধ ঘোষণা করেছে। মোদি রাম মন্দিরের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছেন এবং সারা দেশে অনুষ্ঠানের লাইভ স্ক্রিনিংয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
অনেক শহরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক জাফরান রঙের পতাকা সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনেক রাজনীতিবিদ, নামকরা চলচ্চিত্র তারকা এবং শিল্পপতিরাও উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের বেশ কিছু বিরোধী নেতা সোমবারের এই জমকালো অনুষ্ঠান বর্জন করছেন। তাদের মতে, এটি মোদির রাজনৈতিক কৌশল। সে হিসেবে মোদির এই তথাকথিত ‘মহৎ’ কর্মকে নিন্দাও করছেন তারা। রাজনৈতিক লাভের জন্য ধর্মকে তোষণ করার অভিযোগ করছেন তারা। চারটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে অস্বীকার করেছে। তাদের মধ্যে দুটি কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, একটি অসমাপ্ত মন্দির উদ্বোধন করা হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে যায় এবং মোদি একজন ধর্মীয় নেতা নন এবং তাই অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নন।
ড. জিয়া উস সালাম বলেছিলেন যে, মোদি তার বিশ্বাসের প্রকাশ্য প্রদর্শনী করে রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে একটি রেখা মুছে দিয়েছেন যা তার কট্টর সমর্থকদের উৎসাহিত করেছে।
তিনি আরো বলেন, “শেষ কবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন? এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে তিনি কেবল বিজেপি নেতা বা হিন্দুত্বের মাসকট হিসাবে আচরণ করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার ভূমিকা খুব কমই।”