চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সতর্ক ভারসাম্য চায়

অনুপম দেব কানুঞ্জনা

ডয়েচে ভেলের রিপোর্ট
সম্প্রতি টানা চতুর্থ মেয়াদে বিজয়ী হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। তবে চীন ও ভারত যখন দ্রুততার সঙ্গে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তখন দেশটির পশ্চিমা অংশীদাররা গণতন্ত্রের পশ্চাৎধাবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রভাব বিস্তারের বলয় বৃদ্ধি করতে ছোট ছোট দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে এশিয়ার এই দুটি শক্তিধর দেশ আগ্রহী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারত ও চীনের সঙ্গে স্বার্থের দিক দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সফলভাবে দুটি মহাশক্তির প্রতিযোগিতার ফল ভোগ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিংয়ের সঙ্গে এর অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি ডয়েচে ভেলেকে আরও বলেন, আমরা এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটিতে অর্থায়ন করছে চীন। ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে এতে ঢাকার আরেকটি সফলতার প্রতিফলন ঘটেছে।

বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চীন
গত বছর শেখ হাসিনার নামে কক্সবাজারে একটি ১.২ বিলিয়ন ডলারের সাবমেরিন ঘাঁটি উদ্বোধন করেছে বাংলাদেশ। এই ঘাঁটি নির্মিত হয়েছে চীনা সহায়তায় এবং এটা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে, ভারতীয় বলয়ে গোপনে প্রভাব বিস্তার করছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে পিএলএর সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে বাংলাদেশকে চীনের বিবেচনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ হলো ১.৫ বিলিয়ন ডলার।

২০১৬ সাল থেকে চীনের বিশ্বে অবকাঠামোর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের প্রকল্প- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা নদী। এই নদীর ওপর চীনা অর্থায়নে একটি প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্প নিয়ে নয়া দিল্লির সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হতে পারে।
এই নদীর উল্লেখযোগ্য অংশে ড্রেজিং এবং তীর রক্ষামূলক বাঁধ নির্মাণে চীনের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কথিত ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে’ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, চীন যদি বিশেষ করে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আরও অগ্রসর হতে চায় তাহলে একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

এক দশক ধরে সমঝোতা চেষ্টার পর বাংলাদেশ ও ভারত এই নদীর পানি বন্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ার পর চীনের ওই প্রস্তাব এসেছে। তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি ২০১১ সালে মুলতবি হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে।

ভারতের শিলিগুঁড়ি করিডোরকে বলা হয় চিকেন নেক। এই করিডোরটি প্রস্তাবিত ওই তিস্তা প্রকল্পের কাছে। ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সংকীর্ণ একটি অংশের মাধ্যমে ভারতের অন্য ভূখণ্ডের সঙ্গে এই করিডোর উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সংযুক্ত করেছে। ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে এর রয়েছে স্পর্শকাতরতা। ভারতের আশঙ্কা বাংলাদেশে এই প্রকল্পে উন্নয়ন কাজের নামে এই করিডোরের কাছে নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে চীন।

তৌহিদ হোসেন বলেন, এই উন্নয়ন প্রকল্প অভ্যন্তরীণ ও ব্যাপক ভিত্তিতে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ কি পশ্চিমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হবে?
বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। এর ফলে দলটি নির্বাচন বর্জন করেছে। এ অবস্থায় ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমারা সমালোচনা করেছেন। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পশ্চাৎপসারণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনাকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বাংলাদেশে এই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে স্বীকার করে না। নির্বাচনের পর ৯ই জানুয়ারি নিজ দল আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীদের এক সভায় ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে, বিএনপি তার অজ্ঞাত বিদেশি প্রভুদের পক্ষে কাজ করছে। ২০২৬ সালে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ (এলডিসি)-এর তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার কথা বাংলাদেশে। এই পটপরিবর্তনের পরে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রত্যাহারের আগে তিন বছর সময় পাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ধরে রাখতে বিকল্প পন্থা ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেন, এলডিসি তালিকায় যে সুবিধা আমরা পাই তা পুনর্বহাল করার জন্য বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ যদি একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অথবা অর্থনৈতিক জোটে প্রবেশ করে তাহলে সহজেই সে এসব জোটের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।

বাংলাদেশে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য তিনি পরিচিত। তার সঙ্গে বুধবার সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। এই সাক্ষাতের পর হাছান মাহমুদের ইউরোপের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক এবং ইউরোপের সঙ্গে গভীর বোঝাপড়া থাকার প্রশংসা করেন হোয়াইটলি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক হবে নতুন ‘পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন এগ্রিমেন্টের’ (পিসিএ) ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেন, আইনগতভাবে বাধ্য এই চুক্তি নিয়ে শিগগিরই সমঝোতা হবে এবং এটা হবে বিদ্যমান চুক্তির চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।

বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশকে একটি পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করা হবে না এবং সুপারপাওয়ারগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, এটি ভারতের মতোই একটি দেশ। তারা কারো কাছে নতি স্বীকার না করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি শক্তিশালী সক্ষমতা দেখিয়েছে।

কুগেলম্যান বলেন, উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে, ভারত ও চীনের সঙ্গে, পশ্চিম ও পশ্চিমা নয় এমন পক্ষের সঙ্গে এবং আরও অনেক পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষভাবে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।

(লেখাটি ডয়েচে ভেলে থেকে অনূদিত)

Exit mobile version