বিদেশে কাজ করতে গেলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যেতে হয়। আবার সংশ্লিষ্ট দেশে যাওয়ার পরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ সুস্থ শরীর নিয়েই বিদেশ যাচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। তারপরও তাদের বড় একটি অংশ প্রবাসে মারা যাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, তাদের বেশির ভাগই আকস্মিকভাবে মারা যাচ্ছেন এবং বয়সে তরুণ। ঋণ নিয়ে কিংবা শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বড় স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যান তারা। কিন্তু স্বপ্নপূরণ হওয়ার আগেই তাদের লাশ হয়ে ফিরতে হয়। দিন দিন এই লাশের মিছিল বাড়ছেই। গত এক বছরে (২০২৩ সাল) জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৫৫২ রেমিট্যান্স যোদ্ধা কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরেছেন। এ সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে বেশি এবং প্রতি বছরই বাড়ছে। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ১২ জনের বেশি প্রবাসী কর্মীর মৃতদেহ দেশে ফিরছে। তাদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানত অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু হচ্ছে বেশি। এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে মৃতদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাধিক্য এবং ধারকর্জ করে বিদেশ গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ ও মজুরি না পাওয়ায় মানসিক চাপকেই প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বিরূপ পরিবেশ, হঠাৎ খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, কর্মে অদক্ষতার মতো কারণগুলোও রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছেন এই খাত নিয়ে কাজ করা কর্মীরা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ১২৬ কর্মীর লাশ দেশে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৫৭ জন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৭৬২ জন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ১০৭ রেমিট্যান্স যোদ্ধার লাশ দেশে আসে। গেল এক বছরে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড মৃতদেহ পরিবহন ও দাফনে আর্থিক সহায়তা বাবদ ১৫ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। এছাড়াও গেল বছর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ও বকেয়া হিসেবে ১ হাজার ৫৬৭ মৃত প্রবাসীর পরিবারকে ১০৫ কোটি ৩১ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৯ টাকা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক যুগ্মমহাসচিব মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিক চাপ। এছাড়াও পরিবেশগত সমস্যা। তিনি বলেন, সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে- পরিবেশগত সমস্যা এবং খাদ্যাভাস। সৌদি আরবের মরুভূমিতে কাজ করার উপযুক্ত না হওয়া এবং রিচ ফুড খাওয়ার অভ্যাস না থাকায় কর্মীরা মানিয়ে নিতে পারছে না। এছাড়াও যেসব কর্মী বিদেশে যায়
তাদের অধিকাংশই গরিব। তারা নানাভাবে ঋণ করে, কেউ সুদে টাকা নিয়ে বিদেশে যান। কিন্তু সেই তুলনায় উপযুক্ত বেতন না পাওয়ায় মানসিব চাপ বেশি পড়ে তাদের ওপর। দুশ্চিন্তা গ্রাস করে তাদের। এ কারণেই বেশি মৃত্যু হয়।
মিজানুর রহমান বলেন, বিদেশ যেতে বেশি টাকা খরচ পড়ায় এই সম্যার সৃষ্টি। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যদি কম টাকায় লোক পাঠাতে পারে, তাহলে কিছুটা হলেও কর্মীরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকার, রিক্রুটিং এজেন্সি ও দূতাবাসগুলোকে আরও উদ্যোগী হয়ে কর্মীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, কম টাকায় বিদেশ পাঠানো এবং যে কাজের জন্য কর্মী নেওয়া হয় সে কাজ করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি এগুলো করা যায়, তাহলে মৃত্যুর হার কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে ব্রেনস্ট্রোক ও হৃদরোগে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। তবে এতো অল্প বয়সে স্ট্রোকে এবং হৃদরোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ অতিরিক্ত মানসিক চাপ। অনেকেই ঋণ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু দেখা যায়, যে টাকা খরচ করে গেছেন তার তুলনায় আয় খুবই কম। এই ঋণ পরিশোধের একটা চাপ সবসময় তাদের থাকে। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ, অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা, নিম্নমানের খাবার, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাও এই ধরনের মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে।
প্রবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তের হার বেশি। এ ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়ার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে, যা হৃদরোগের জন্য দায়ী। আবার অনেকে জানেন না, কোথায় কীভাবে চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো ধরনের চেকআপের মধ্যে না থাকায় অনেকে হৃদরোগে ভুগলেও চিকিৎসা না করায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন সম্প্রতি এই মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পাওয়ায় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, বেশির ভাগ মরদেহই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরবের পর বেশি মরদেহ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে মেডিকেল চেকআপ করে যাচ্ছেন। সে সময় হৃদরোগ ধরা পড়ছে না। বিদেশে পৌঁছার পরও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এ ধরনের কোনো উপসর্গ পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। এছাড়াও অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিকই দালালের প্রলোভনে বেশি ব্যয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, যা তাদের সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখে। আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ কর্মীর মরদেহ দেশে আসছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক। তিনি বলেন, কর্মীদের মরদেহ দেশে আনার পর কখনো ময়নাতদন্ত করা হয় না। ফলে প্রকৃত কারণ কখনোই জানা যাচ্ছে না। সরকারের উচিত মরদেহ দেশের আসার পর ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা এবং সমস্যা নির্ধারণ করে সমাধানের পথ খোঁজা। একইসঙ্গে তিনি বলেন, অভিবাসন খরচ কর্মীদের মানসিক চাপের অন্যতম কারণ। এই অভিবাসন ব্যয় কমানো গেলে কর্মীরা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবেন।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক গবেষণায় বলা হয়, গত তিন বছরে বিদেশে কর্মরত ৪০৪ নারীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বয়সই ৪০ বছরের নিচে।
রামরু জানিয়েছে, ৬৯ শতাংশ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক লেখা হলেও বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুুযায়ী, তিন বছরে বিদেশ থেকে এসেছে ৪০৪ নারী শ্রমিকের মরদেহ। তাদের মধ্যে ২২৭ জন বা ৬৯ শতাংশের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল স্বাভাবিক। সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিকের মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে। রামরু বলছে, বড় রোগ থাকলে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বিষয়টি ধরা পড়ার কথা। তাই মৃত্যু সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা নিয়ে সন্দেহ করছেন মৃত শ্রমিকের স্বজন।
রামরু পরিচালক (প্রোগ্রাম) মেরিনা সুলতানা বলেছেন, প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত প্রয়োজন। দূতাবাসগুলোকেও প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের লাশ দেশে ফেরত পাঠায়। মৃত ব্যক্তিদের পরিবার লাশ দাফনের জন্য বিমানবন্দরে ৩৫ হাজার এবং পরে যারা বৈধভাবে কোম্পানিতে কাজ করেছেন, তারা ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পায়।