নতুন বছরের শুরুতে নতুন সরকার শপথ নিয়েছে। এ সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। নিত্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালে আনতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া। ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সপ্তাহ শেষে বাজারে স্বস্তি ফেরেনি। উল্টো অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে, সেটা এখন হিসাব করা বেশ কঠিন। তবে মোটাদাগে বলা যায়, দাম বেড়েছে প্রায় সব পণ্যেরই। টিসিবির হিসাবে ঢাকা বাজারে ৮ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটা চাল, প্যাকেটজাত আটা, ময়দা, মসুর ও মুগ ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ৪ ধরনের মসলা ও ব্রয়লার মুরগি—এই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ৫০ টাকা। কমেছে আলু ও জিরার দাম।
বাজারে গত কয়েকদিনে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আজ শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
প্রায় সব ধরনের চাল কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া আটা-ময়দা ও ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। তেলের দামও লিটারপ্রতি ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, শীত মৌসুমের সব ধরনের সবজি কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। শিমের দাম প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আর মাঝারি আকারের একটি লাউয়ের দাম ৮০ টাকা, বড় হলে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে- মাছ, মুরগি, ডিম, আদা-রসুনসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যও। গরুর মাংস ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে নিত্যপণ্যের হঠাৎ এমন দাম বৃদ্ধিতে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। তাদের দাবি ভরা মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম কম হওয়ার কথা, কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন।
কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে আসা ক্রেতা উজ্জল বিশ্বাস বলেন, ‘ভরা মৌসুমে এতো দামে সবজি বিক্রি হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বিক্রেতারা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন তার কোন ভিত্তিই নেই। কারণ শুধু সবজি নয়, সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়ছে।’
রাজধানীর মগবাজারে দেখা গেছে, সরু (মিনিকেট) চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। যা সপ্তাহ দুয়েক আগে ছিল ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে সর্বোচ্চ ৬ টাকা বেড়েছে। মাঝারি (বিআর-২৮, পায়জাম) চাল কেজিতে সর্বোচ্চ ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। এছাড়া কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে মোটা চালের দাম। যা বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়।
বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও প্রতি ডজনে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এছাড়া ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২২৫ টাকা। যা গত মাসে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকার মধ্যে ছিল। সোনালি জাতের মুরগির দামও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকায়।
বাজারে এখনও প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। দেশি পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা।
বাজারগুলোতে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা, এক কেজি শিং মাছ (চাষের, আকারভেদে) ৩০০ থেকে ৫০০, রুই মাছের দাম বেড়ে (আকারভেদে) ৪০০ থেকে ৫৫০, মাগুর মাছ ৭০০ থেকে ৯০০, মৃগেল ৩০০ থেকে ৪৫০, পাঙাস ২০০ থেকে ২২০, চিংড়ি ৬০০ থেকে ৮০০, বোয়াল মাছ ৪০০ থেকে ৯০০, কাতল ৪০০ থেকে ৬০০, পোয়া মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০, তেলাপিয়া ২২০, কৈ মাছ ২২০ থেকে ২৩০, মলা ৫০০, বাতাসি টেংরা ৯০০, টেংরা মাছ ৬০০ থেকে ৭০০, কাচকি মাছ ৬০০, পাঁচ মিশালি মাছ ২২০, রুপচাঁদা ১০০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে রোজায় বাজারে চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে পণ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের আগে তিনি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার প্রচলিত ধারায় পরিবর্তন এনে একটি যৌক্তিক মূল্যকে ‘রেফারেন্স প্রাইস’ হিসেবে চালুর পরিকল্পনার কথা বলেন।
আসন্ন রোজা উপলক্ষে চিনি ও ভোজ্যতেলের মজুদ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বৈঠক করেন নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।
সরকারের কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়ে প্রতিমন্ত্রী টিটু বলেন, ‘দাম থাকবে যৌক্তিক ও স্বচ্ছ। রেফারেন্স প্রাইসগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ওপর থাকবে। যেকোনো মূল্যে বাজারে সরবরাহটা নিশ্চিত করতে চাই।’
ক্রেতাদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বছরের প্রথমে বাজারে বাড়তে শুরু করেছে চালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। তার কারণ তিনটি। প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকারের পক্ষে সেটি কঠিন। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ, সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে।