কেন ইরান-পাকিস্তান যুদ্ধে লিপ্ত?
- বালুচিস্তানের গোয়াদর ও চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের সংযোগ প্রকল্প চলমান
বৃহত্তর বালুচিস্তানে সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোই সংঘাতের মূলে রয়েছে
ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তানে হামলা চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
ইরানের হামলায় পাকিস্তানের বালুচিস্তানে দুই শিশু নিহত।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের কালাত জেলাই ছিল বৃহত্তর বালুচিস্তানের প্রাণকেন্দ্র। মুঘল আমল থেকেই এ কালাত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে আসছিল বালুচ শাসনব্যবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার আলোচনার সময় বালুচিস্তান নিয়ে বিশেষ আলোচনা চলছিল। কালাতের নেতা মির আহমাদ খান যিনি ‘কালাতের খান (খান অব কালাত)’ নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি বৃহত্তর বালুচ অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবিতে অনড় থাকেন। দিল্লিতে ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট যখন জওহরলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহসহ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা স্বাধীনতার শেষলগ্নে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন কালাতের খান ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট দিল্লি থেকে জানান, স্বাধীন বালুচিস্তান রাষ্ট্র হতেই হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে উপমহাদেশে ভেঙে তৈরি হতে থাকা পাকিস্তানের নেতা খোদ জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলি খান (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) চুক্তি করেন কাতালের খানের সঙ্গে। শেষমেশ ১২ আগস্ট সত্যি সত্যি বালুচিস্তান স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কালাতের খান নিজের ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ আরও পোক্ত করতে ১৯৪৮ সালে আরও একবার বালুচিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কালাতের আইনসভায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ওই বছরের ২৭ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বালুচিস্তান আক্রমণ করলে খান আত্মসমর্পণ করেন। খানকে করাচিতে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়, যা গৃহীত হয় ১৯৪৮ সালের ৩০ মার্চ। অবশেষে বালুচিস্তানের ২২৭ দিনের স্বাধীনতার মৃত্যু হয়। এর মধ্য দিয়ে কালাত বংশের ৩০০ বছরের সালতানাতেরও সমাধি হয়।
এই তো গেল পাকিস্তানি বালুচদের স্বাধীনতার মৃত্যুর গল্প। সুন্নি ইসলামি মতের অনুসারী বালুচদের ভূখণ্ডের একটি অংশ এখন পড়েছে ইরানি বালুচিস্তানে। বালুচরা যেভাবে নবগঠিত পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতা হারিয়েছে, ইরানি শাসকদের কাছেও একইভাবে তা হারিয়েছে। উনিশ শতকে পারস্য রাজ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাগাভাগিতে পড়ে বৃহত্তর বালুচিস্তানের বুকে ছুরি পড়ে। ওই সময়ই পারস্য সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়ে যায় পশ্চিম বালুচিস্তান, যা আজ সিস্তান-বালুচিস্তান নামে পরিচিত। একসময় পশ্চিম বালুচিস্তান ভূখণ্ডটি স্বাধীন অঞ্চলের মতোই বিরাজ করছিল। কিন্তু ১৯২৮ সালে ইরানের পাহলোভি রাজবংশের রাজা রেজা শাহ পাহলোভি অঞ্চলটিকে জোরপূর্বক নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
১৯৭৯ সালে ইরানে রেজা পাহলোভির শাসন উৎখাত করে শিয়া মতাবলম্বী ইসলামি বিপ্লবের সূচনা হয়। পাহলোভি থেকে এখনকার শিয়া মতাবলম্বী প্রশাসন– কারও রোষানল থেকেই বাঁচতে পারেনি বালুচরা। সিস্তান-বালুচিস্তান ইরানের ৩১টি প্রদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চল যার জনঘনত্ব বেশ কম। মাঝেমধ্যেই সেখানে ইরানি প্রশাসনের সঙ্গে গেরিলাদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়।
একই ভাষা, একই নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও একই রকম দৈহিক আঙ্গিকের বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বৃহত্তর বালুচিস্তান এখন তিন দেশের বিভক্ত। তবে মূল বালুচিস্তান পড়েছে পাকিস্তানেই। এর বাইরে আফগানিস্তানেও পড়েছে কিছু অংশ। ব্রিটিশ ও পারস্য রাজের ভাগাভাগির সমীকরণ, পরবর্তী সময়ে নতুন শাসকগোষ্ঠীর উত্থান এবং বিগত কয়েক দশকের শাসকদের অব্যাহত নিপীড়নের মধ্যেই দিন পার করছে বালুচরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তানে হামলা চালিয়ে নয়জনকে হত্যা করেছে পাকিস্তান। মূলত আগের দিন পাকিস্তানের বালুচিস্তানে সুন্নি সশস্ত্র গেরিলা দলের ওপর হামলা চালাতে গিয়ে দুই শিশুকে হত্যার পরই ইসলামাবাদ ইরানি ভূখণ্ডে ওই হামলা চালাল। মধ্যপ্রাচ্যে হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের চলতি আবহের মধ্যে এ লড়াই যেন আচমকা। পাকিস্তান এরই মধ্যে অপারেশন ‘মার্গ বার সারমাচার’ শুরু করেছে। ঘটনা প্রবাহের জেরে প্রথম হামলার শিকার হয়ে পাকিস্তান নিজ দেশের ইরানি দূতকে ইসলামাবাদে না ফেরার কথা জানিয়ে দিয়েছে এবং তেহরানের নিযুক্ত নিজের দূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সারা পৃথিবীতে যতগুলো জাতিগত সংকট দেখা যায়, তার মধ্যে বালুচদের এ সমস্যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ সংকটকে প্রায় আড়ালেই থাকতে দেখা যায়। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার আড়ালে মূল সত্যটি হচ্ছে, বালুচদের জাতীয়তাবাদী আকা•ক্ষার সঙ্গে শত্রুতা রয়েছে ইরান ও পাকিস্তান দুই দেশেরই। দুটি রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যাহত নিপীড়নের মুখে দাঁড়িয়েও বালুচ সশস্ত্র প্রতিরোধ এখনও নিভু নিভু আলোয় জ্বলছে।
ইরানের হঠাৎ হামলায় মনে হতে পারে, পাকিস্তান বুঝি বালুচিস্তানের প্রতি বেশ সহানুভূতিপূর্ণ। বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। বরং এই তো কয়েক দিন আগে রাজধানী ইসলামাবাদে বালুচ নারীদের একটি মাসব্যাপী লংমার্চে ব্যাপক ধরপাকড় চালাল পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী। সেখানকার নারীরা বালুচিস্তানে অব্যাহত হত্যা, খুন ও গুমের প্রতিবাদে লংমার্চ আয়োজন করে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা সময় বালুচিস্তানে নির্যাতন-নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, নির্মম কায়দায় বালুচদের জাগরণকে ঠেকিয়ে রেখেছে দুই দেশ। এখন যা চলছে তা হচ্ছে স্রেফ সাময়িক উত্তেজনা, বরং দুই দেশে অবস্থান করা অস্ত্রধারীদের শায়েস্তা করতে পারলে একে অন্যের খুশি হওয়ারই কথা। মোটকথা হলো, বালুচ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দমিয়ে রাখতে সবসময়ই সক্রিয় ছিল ইরান ও পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্র। দুই দেশই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, ‘সন্ত্রাসীরা’ প্রতিবেশী ভূমি ব্যবহার করে হামলা করছে।
ইরানের শিয়া মতাবলম্বী প্রশাসন মনে করে, সুন্নি ধর্মীয় মতাদর্শের জনগোষ্ঠী বালুচদের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ইসলামি বিপ্লবের সমর্থক প্রশাসনের জন্য হুমকি। সিস্তান-বালুচিস্তানের বালুচদের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খার সঙ্গে মিশে রয়েছে ‘সুন্নি বনাম শিয়া’ প্রভেদ যা তেহরানের জন্য মাথাব্যথার কারণ। ওই অঞ্চলে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) সঙ্গে সুন্নি অস্ত্রধারী বালুচ সংগঠনের সংঘাতের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়।
সামরিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালুচদের সশস্ত্র আন্দোলন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চলার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের বালুচিস্তানেও নানা ভাগে বিভক্ত স্বাধীনতা আন্দোলন চলছিল। বালুচিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রাদেশিক সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধামন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭৩ সালে তা বাতিল করে দেন এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকার ভাঙার অভিযোগ আনেন। বালুচরা এ ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বালুচদের অধিকারের পথ সংকুচিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে ইসলামি ভাবাদর্শ, মার্ক্সবাদী-মাওবাদী-লেনিনবাদী ধারা কিংবা নিখাদ জাতীয়তাবাদী ঘরানার সশস্ত্র আন্দোনের প্রতি মানুষের সমর্থন জোরদার হতে থাকে। বালুচ স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বড় সংকটের জায়গা হলো, অঞ্চলটিতে বুগতি, মারি ও মেঙ্গালসহ নানা গোত্রের বসবাস, যা জাতীয় ঐক্যের পথে মাঝেমধ্যেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার বালুচ ভূখণ্ডে যে একমাত্র বালুচ ভাষাই প্রচলিত তাও নয়। যেমন বালুচদের ২২৭ দিনের স্বাধীনতার কেন্দ্র কালাতে ব্রহি ভাষাই প্রধান। সব মিলিয়ে বালুচদের অনৈক্য পাকিস্তানি সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের পথ প্রশস্ত করেছে।
বালুচদের সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম নাম বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), যার মধ্যে মারি উপজাতিদের প্রভাব রয়েছে। এর প্রধান নেতা বালাচ মারিকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ২০০৭ সালে হত্যা করে। বালুচ রিপাবলিকান পার্টির (বিআরপি) নেতা আকবর বুগতিকে হত্যা করা হয় ২০০৬ সালে। বর্তমানে তার নাতি ব্রাহামদাগ বুগতি সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। এর সামরিক শাখা দীর্ঘদিন সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িত ছিল। এ ছাড়া বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) সক্রিয় রয়েছে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ইরানে থাকা বিএলএ এবং বিএলএফের ঘাঁটিতে হামলা করেছে।
ইরানি শিয়া প্রশাসনের বিরুদ্ধে সুন্নি বালুচদের বিদ্রোহ
পাকিস্তানের সঙ্গে চলতি উত্তেজনায় সবচেয়ে বেশি যে গোষ্ঠীর কথা শোনা যাচ্ছে, তা হলো ‘জুনদাল্লাহ (আল্লাহর সেনা)’। এই জুনদাল্লাহর সদস্যদের নিয়ে ২০১২-১৩ সালের দিকে যাত্রা করে জইশ আল-আদল। মূলত এ সংগঠনের যোদ্ধাদের লক্ষ্য করেই পাকিস্তানের ভেতরে হামলা চালিয়েছে ইরান। ২০০২ সালের প্রতিষ্ঠিত জুনদাল্লাহর মতাদর্শের যোদ্ধারাই এখন পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী সিস্তান-বালুচিস্তানের নানা জায়গায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আইআরজিসির কর্মকর্তা ও শিয়া জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় তারা। জুনদাল্লাহার শীর্ষ নেতা ছিলেন আলদুলমালেক রিগি। ২০১০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে ইরানি কর্তৃপক্ষ এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইরান অভিযোগ করে, জইশ আল-আদলসহ অন্যান্য আরও কিছু সুন্নিপন্থি বালুচ সংগঠন পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে ইরানে হামলা চালায়। এসব সংগঠনকে সহযোগিতা করে ইসরায়েল, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা।
ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনায় চীন কী চাইছে
এশিয়ায় চীনের বড় মিত্র হচ্ছে ইরান। পাকিস্তানের সঙ্গেও চীনের সখ্য বেশ। বর্তমানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসের (বিআরআই) অধীনে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)’ প্রকল্প চলমান। ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফের শাসনামলে পাকিস্তান এতে সই করে। এ চুক্তির আওতায় চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের সঙ্গে রেলপথ, রাজপথ ও জ্বালানি সঞ্চালন পথ নির্মাণ করে বালুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরকে সংযুক্ত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রয়েছে। চীনের লক্ষ্য হচ্ছে, এ সংযোগকে কাজে লাগিয়ে ইরান হয়ে উপসাগরীয় অন্যান্য দেশ থেকে মধ্য-এশিয়া পর্যন্ত যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। আফগানিস্তানের তালেবান ক্ষমতায় আসার পর চীনের এ লক্ষ্য আরও বর্ধিত হয়েছে।
অর্থাৎ পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা চীনের স্বার্থকে বাজেভাবে আঘাত করছে। এ কারণে আসরে নেমেছে বেইজিং। তারা দুই পক্ষের শত্রুতাকে বাড়তে দিতে চায় না। এরই মধ্যে চীনের তরফ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে, দুই দেশ যেন সংযম বজায় রাখে।