রওশন এরশাদকে সামনে রেখে আলাদা দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির একাংশের নেতারা। সেই লক্ষ্য নিয়ে চলছে রওশনপন্থি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির তৎপরতা। প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠকও করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীর অনেকেই এখন রওশনপন্থিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তারাও জি এম কাদেরপন্থিদের বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠনের তাগিদ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
রওশন এরশাদের অনুসারীরা মনে করেন, জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির রাজনীতি বিপন্ন হওয়ার পথে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এক সময় তারা সর্বস্বান্ত রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে—যার আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। জেলা পর্যায়ের নেতারা আর কাদেরের নেতৃত্বে দল করতে চান না বলেও দাবি তাদের।
দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী ও গত দুটি সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী মার্চের মধ্যে দলের সম্মেলন করতে চান তারা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ফেব্রুয়ারিতে তারা সারা দেশের নেতাকর্মীদের নিয়ে বড় পরিসরে বসবেন। সম্মেলনের মাধ্যমে রওশন এরশাদকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক বা প্রধান উপদেষ্টা রেখে এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদকে চেয়ারম্যান ও গোলাম মসিহকে দলের মহাসচিব করার চিন্তা করা হচ্ছে।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরুর পর বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব নিয়ে বিবাদে ভাঙনের মুখে পড়েছে জাতীয় পার্টি। বর্তমানেও মূল ধারার জাতীয় পার্টি অন্তত চারটি ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি অংশ জি এম কাদেরের নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদে বিরোধী হওয়ার পথে। আরেক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন রওশন এরশাদ। দলীয় বিভাজনের কারণে তারা এবার লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করেননি। এ ছাড়া এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার কিছু অনুসারীও জাতীয় আলাদা অবস্থান নিয়ে আছেন। তারাও দল গঠনে সময়-সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। সর্বশেষ নির্বাচন কেন্দ্র করে জি এম কাদেরপন্থিদের একটি অংশ এখন আলাদা অবস্থান নিয়েছে। তাদের কেউ কেউ পৃথক কমিটি ঘোষণার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
দল পুনর্গঠনের বিষয়ে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসিহ বলেন, ‘আমরা নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে যাইনি। আমরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছি। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নজরে রাখছি।’
জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা সংগঠিত হচ্ছি। একটি দল চোখের সামনে এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না। জি এম কাদের যেভাবে দল পরিচালনা করছেন, এতে জাপা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। সর্বশেষ পার্টির পরাজিত প্রার্থীদের বক্তব্য থেকে ভেতরের চিত্র বেরিয়ে এসেছে, যা খুবই হতাশাজনক। আমার কাছে মনে হয়, জাপা আর এগিয়ে যেতে পারবে না। দলটির শেষ হওয়া শুরু হয়েছে। এজন্য আমরা ম্যাডামের (রওশন) নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে চাই। আগামী মাসের মধ্যে সম্মেলনের তারিখ ঠিক হবে।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে জাপায় এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে দুটি বলয় তৈরি হয়। সে দুটি বলয় এখন প্রকাশ্য দুই শিবিরে বিভক্ত। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরেও দুপক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি চরম রূপ নেয়। অনুসারীদের দলের মনোনয়ন না দেওয়ায় শেষপর্যন্ত রওশন এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জি এম কাদেরের সঙ্গে জোট না করার আহ্বানও জানান তিনি।
তবে শেষপর্যন্ত রওশনপন্থিদের বাইরে রেখেই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় ২৬টি আসন ছাড় পেলেও জয়ী হন মাত্র ১১ জন। এ ছাড়া এককভাবে আরও ২৩৯টি আসনে নির্বাচন করে সবগুলোতেই হেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। ৯০ শতাংশ প্রার্থী জামানত রক্ষা করতে পারেননি।
অন্যদিকে, রওশন এরশাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অন্তত ৪০ নেতা রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও কেউ পাস করতে পারেননি।
নির্বাচন শেষে দলের নেতারা জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য, সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিলেও দলের প্রার্থীদের কোনো ধরনের সহযোগিতা না করাসহ নানা অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করেন। সেইসঙ্গে দলের দুই শীর্ষ নেতার পদত্যাগও চান তারা। এ ঘটনা রওশনপন্থিদের জন্য সাপে বর হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে তারা নতুন দল গঠনের জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে দেখছেন।
সব মিলিয়ে অনেক দিন ধরে জিইয়ে থাকা জি এম কাদের ও রওশনের দ্বন্দ্ব এবার দলের ভাঙনে রূপ নিচ্ছে। নির্বাচন ইস্যুতে ক্ষুব্ধ নেতাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে রওশনপন্থি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় একের পর এক নেতাকে বহিষ্কার করছেন জি এম কাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘রাজনৈতিক বিষয়ে ফেব্রুয়ারিতে সিদ্ধান্তের পর মার্চের দিকে আমরা সম্মেলনে যেতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর কোনো জেলার নেতারাই জি এম কাদেরের সঙ্গে রাজনীতি করতে চাইছেন না। সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা আমাদের সঙ্গে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে যোগাযোগ করছেন। সব দিক মাথায় রেখেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’
তবে দল ভাঙার এসব তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে মনে করেন জি এম কাদেরপন্থি নেতারা। যোগাযোগ করা হলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এক আছে। কোনো কোন্দল নেই। বাইরের কোনো শক্তি ইন্ধন দিয়ে দলে নানা মেরূকরণ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। আমরা তাদের সফল হতে দেব না।’
দলে সম্ভাব্য ভাঙনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামকে (রওশন এরশাদ) ভুল বুঝিয়ে এ ধরনের অপচেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছে। কিন্তু কেউ কিছুই করতে পারিনি। রাজনৈতিক দল হলো একটি ট্রেনের মতো। ট্রেন যেখানে থামবে, সেখানে কিছু যাত্রী নেমে যাবে, কিছু নতুন মুখ যুক্ত হবে—এটাই স্বাভাবিক।’
জানা গেছে, জাতীয় পার্টি নামে এখন রাজনীতিতে সক্রিয় দল আছে পাঁচটি। এর মধ্যে চারটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশনে এ দলটি নিবন্ধিত লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) নিবন্ধিত বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে। জাপার প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুরের জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ। এরশাদ শাসনামলের শুরুর দিকের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডা. এম এ মতিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এই দলটির প্রতীক কাঁঠাল। এম এ মতিনের মৃত্যুর পর এ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তার ছেলে ডা. এম এম মুকিত।
এ ছাড়া এরশাদের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের অনুসারীরা জাতীয় পার্টি (জাফর) নামে আরেকটি অংশে সক্রিয় আছেন। এই দলটি বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে।