দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে গত ৯ জানুয়ারি। সেই হিসাবে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, সংরক্ষিত ৫০ নারী আসনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনের অনুমোদন পেলেই তফসিল ঘোষণা করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
সংবিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি ছয়জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বিপরীতে একজন মহিলা সংসদ সদস্য পাবে। সেই হিসাবে আওয়ামী লীগ এবার ২২৩টি সাধারণ আসনের জন্য পাবে ৩৭টি সংরক্ষিত আসন। জাতীয় পার্টি বিজয়ী ১১ আসনের বিপরীতে পাবে ২টি। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন জিতেছে। এই তিন দল দলগতভাবে সংরক্ষিত আসন পাবে না। তবে কোনো জোট করলে আসনের প্রশ্ন আসতে পারে। এদিকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ৬২ সংসদ সদস্য জোটবদ্ধ হলে পাবেন ১০টি আসন। তবে স্বতন্ত্ররা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীদের মতোই শেখ হাসিনার ওপর দায়িত্ব দিয়ে দিতে পারেন বলে দায়িত্বশীল সূত্রের খবর। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি দুটি সংরক্ষিত আসনে কাদের নির্বাচিত করবে, এ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কারণ সংরক্ষিত আসনে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী
রওশন এরশাদ সদস্য হতে চাইবেন। এদিকে সূত্র বলছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বর্ষীয়ান এ নেত্রীকে মনোনয়ন দিতে অনাগ্রহী। ফলে এ নিয়ে অগ্নিপরীক্ষায় আছে দলটি। আর ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি সংরক্ষিত আসন না পাওয়ার শঙ্কায় আছে।
সংরক্ষিত নারী আসনে সাধারণত আসনের চেয়ে বেশি প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিলে নির্বাচনের প্রশ্ন আসে। তবে বিগত সময়ে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের ইতিহাস খুব একটা নেই। ফলে দল বা জোট মনোনীত প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। সে কারণে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যে দলটির সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণে নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সরাসরি সভাপতিকে তাদের ইচ্ছার কথাটা জানিয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকে নেত্রীর কাছে পৌঁছতে না পেরে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে যাচ্ছেন। এ দৌড়ে সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছাড়াও রয়েছেন আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগসহ লেখক, শহীদ পরিবারের সন্তান, অভিনয়শিল্পীরাও।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও তিন নেত্রীকে জোট ও শরিকদের জন্য আসন ছাড়তে হয়েছে। তারা হলেন- লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফরিদুন্নাহার লাইলী, গাইবান্ধা-১ আসনে আফরুজা বারী এবং গাইবান্ধা-২ আসনে মাহবুব আরা বেগম গিনি। সংরক্ষিত নারী আসনে তাদের এবার দেখা যেতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে এবার স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে হেরেছেন সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি এবং ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক সাবিনা আক্তার তুহিন। তিনিও মনোনয়ন ফরম নেবেন বলে জানা গেছে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমা আক্তার লাবণ্য সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম উঠাবেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রোকেয়া সুলতানাও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ দলের মনোনয়ন পেলেও দ্বৈত নাগরিকত্বের জটিলতার কারণে নির্বাচন করতে পারেননি। সংরক্ষিত নারী কোটায় তাকে সংসদে আনার বিষয়ে দলে বেশ আলোচনা চলছে। তিনি নিজেও আগ্রহী বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে হেরে যাওয়া দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সংরক্ষিত আসনের সাবেক সদস্য সানজিদা খানম নৌকার মনোনয়ন পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। সংরক্ষিত কোটায় সংসদে আসার বিষয়ে তিনি নিজেও আগ্রহী।
আওয়ামী লীগের সাবেক এমপিদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নাটোর-৪ আসনের প্রয়াত এমপি আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী কুহেলী কুদ্দুস মুক্তি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয় শহীদ সুলতানা কামালের ভাতিজি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য নেহরীন মোস্তফা দিশি সংরক্ষিত আসনে সদস্য হতে চান। শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রখ্যাত সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে লেখক শাওন মাহমুদের নাম আছে আলোচনায়।
যুুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অধ্যাপিকা অপু উকিল, যুব মহিলা লীগের সভাপতি ডেইজি সারোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলিও চান সংরক্ষিত আসনের সদস্য হতে। এ ছাড়া দৌড়ঝাঁপ করছেন অভিনেত্রী তারিন জাহান, অরুণা বিশ্বাস, তানভীন সুইটি, রোকেয়া প্রাচী, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তারসহ চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরও কিছু জনপ্রিয় মুখ। তা ছাড়া সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অভিনেত্রী তারানা হালিম, জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে হেরে যাওয়া চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিও রয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হওয়ার দৌড়ে। এ ছাড়া অনেক জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেত্রীরাও রয়েছেন এই দৌড়ে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বাছাই করবেন। তিনি জানেন কে যোগ্য আর কে অযোগ্য।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, মনোনয়ন না পাওয়া এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে না পারা ত্যাগী নেতারা সংরক্ষিত আসনে অগ্রাধিকার পাবেন। তবে তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় রাখা হবে।
সংরক্ষিত আসনে জাতীয় পার্টির দুজনের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন- রওশন এরশাদ ও সালমা ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, তফসিল হওয়ার পর এ নিয়ে আমরা কথা বলব। আপাতত এ নিয়ে ভাবছি না।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমি এখনো এ বিষয়ে কিছু ভাবছি না। আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় আছি। ঢাকায় ফিরে কথা বলব।
এদিকে সংরক্ষিত নারী আসনে ফেব্রুয়ারিতে ভোটগ্রহণের বিষয়ে গতকাল ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ভোটার সংসদ সদস্যদের তালিকা আমরা সংসদ থেকে পেয়েছি। ভোটার তালিকা যেভাবে প্রকাশ করা হয়, সেভাবে সংসদে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রকাশ হওয়ার পর যদি কোনো আপত্তি না থাকে সেটাই চূড়ান্ত হবে। পরবর্তীকালে কমিশনের অনুমোদনক্রমে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, ভোটার তালিকা পাওয়ার পর আগামী সপ্তাহে কমিশনে এটি তোলা হবে। কমিশন অনুমতি দিলে তফসিল ঘোষণা হবে। কমিশনের অনুমোদনে আগামী সপ্তাহে তফসিল হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
আইন অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের ফলের গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। গত ৯ জানুয়ারি গেজেট হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের। সেই হিসাবে আগামী ৭ এপ্রিলের মধ্যে সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভোট করতে হবে ইসিকে। ভোটার তালিকা প্রস্তুতসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে ইসিকে ২০ ফেব্রুয়ারির পরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।