প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধে সারাদেশে আওয়ামী লীগের সহিংসতা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই আছে। মূলত, এরা একই দলের নেতাকর্মী হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে দলীয় কোন্দল। ঝিনাইদহে নৌকার সমর্থক ও নোয়াখালীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের বিরোধী প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
তথ্য সূত্রগুলো বলছে, গতকাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, দলীয় স্বতন্ত্র, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা ১৪ দলের শরিক ও জাতীয় পাটির কমপক্ষে ২৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন কারচুপি এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। আওয়ামী লীগের ৪ জন, শরিক দলের (নৌকা প্রতীকের) ২ জন এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ১৬ জন প্রার্থী এই তালিকায় রয়েছেন। বাকিরা অন্য রাজনৈতিক দলের।
এর আগে শনিবার রাতে নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূঁইয়ার নির্বাচনি এজেন্ট শাহেদুজ্জামান পলাশকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ দুর্বৃত্তরা। ঝিনাইদহে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় পরাজিত নৌকা প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর কর্মী বরুণ কুমার ঘোষকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঝিনাইদহ শহরের ঘোষপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় আহত হয়েছে ৬ জন। এদের মধ্যে দুজনকে মাথায় ও কোমরে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। কুমারখালীতে কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষে তারা আহত হন। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা) আসনের বিজয়ী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রউফ ও পরাজিত দলীয় প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের সমর্থকদের মধ্যে এসব সংঘর্ষ হয়।
খুলনা-৪ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন শিল্পপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম মোর্তজা রশিদী দারা। তিনি (দারা) আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই। মোর্তজা রশিদী দারার হয়ে নির্বাচনে কাজ করেছিলেন কুদলা গ্রামের রিলি বেগম ও তার স্বামী মোহাম্মদ এসকেন্দ শেখ। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শুরুর কিছুক্ষণ পর তাদের ওপর হামলা হয়। এতে এসকেন্দ শেখ ও তার স্ত্রী রিলি বেগম আহত হন।
খুলনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। এ আসনে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। নির্বাচনে আকরাম হোসেনের হয়ে কাজ করেছিলেন শোভনা ইউনিয়নের আবদুর রহিম ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। ভোটের পরদিন সোমবার আবদুর রহিমের বাড়িতে হামলা করে নৌকার সমর্থকরা। তারা আবদুর রহিমকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে মারধর করে।
নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে গত শনিবার সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বেলকুচির কামারপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়িতে এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, ভোটের পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মমিন মন্ডলের ছত্রছায়ায় তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ভয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকরা বাড়িঘর ছেড়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৬ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে।
নওগাঁ-১ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামান তার কর্মীদের মারধর, বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার অভিযোগ করেছেন। এ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের অনুসারীরা এসব হামলা চালিয়েছেন বলে তার দাবি।
ভোটের দুই দিন পর সংবাদ সম্মেলন করে মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ অভিযোগ করে বলেন, সূক্ষ্ম কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি পরাজিত হয়েছেন। ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সানজিদা খানম ৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর পৃথক আবেদনে একই অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ওই আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. মো. আওলাদ হোসেন।
নির্বাচনের দুই দিন পর মঙ্গলবার এক কর্মী সভায় মানিকগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, কয়েকটি কেন্দ্রে কারচুপি করে তাকে হারানো হয়েছে। বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু পরাজিত হওয়ার পর কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। পাবনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল হামিদ কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপিসহ অনিয়মের নানা অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, এজেন্ট বের করে দেওয়া, জাল ভোটসহ নানা অভিযোগ করেছেন রাজবাড়ী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরে আলম সিদ্দিকী হক, কুষ্টিয়া-৩ আসনের পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ার এবং ফরিদপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন।
অবৈধ নির্বাচন অবৈধ পার্থি।