দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো। এই দাবিতে এরইমধ্যে দুই দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে দলগুলো। এরপর নতুন কোনও কর্মসূচি না দিয়ে গত ৯ জানুয়ারি থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সরাসরি ও ভার্চুয়ালি এসব সভায় অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও।
বিএনপির নেতারা বলছেন, চলমান আলোচনা আরও অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম-পিপলস পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (১৩ জানুয়ারি) গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন বিএনপির নেতারা।
এসব আলোচনায় সদ্য বিগত আন্দোলনের বিচার-বিশ্লেষণের পাশাপাশি ইস্যু হিসেবে নতুন বিষয়ের অনুসন্ধান করছেন তারা। ইতোমধ্যে একাধিক দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের ভাষ্য, ‘দেশের মানুষ সদ্য বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে বার্তা দিয়েছেন, তাদের এই ভোট-বর্জনের সিদ্ধান্তকে কীভাবে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, বিশেষ করে ভারত যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য না দিয়ে একটি দলকে সাপোর্ট করেছে। ভারত কেন একটি দলকে সাপোর্ট করবে? আমরা চাই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকুক। ভারত তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, একই নিরাপত্তা আমাদেরও প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো আমাদের আলোচনায় এসেছে।’
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভারত সহযোগিতা দিয়েছে— এমন অভিযোগ বিএনপির পক্ষ থেকে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যে করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিদায়ী বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বেশ কয়েকবার ভারত সম্পর্কে মন্তব্য করেন। ২৬ নভেম্বর অবরোধ চলাকালীন রিজভী বলেন, ‘ভারত সরকার ও তাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিত— বাংলাদেশের জনগণ কেন তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন দিয়ে তারা (ভারত) বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’
১ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে রিজভী উল্লেখ করেন, ‘‘ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য আছে। সেই ভারত সরকার সরাসরি কীভাবে একটি ‘অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের’ পক্ষে অবস্থান নেয়! তারা মুখে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে আছে বললেও বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা অতীব দুঃখজনক।’’
২২ ডিসেম্বর তিনি আবারও বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে দিল্লি। অতীতের তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মতোই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিল্লির প্রকাশ্য প্রভাবে জনগণ উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বৈঠক বসছে দিল্লিতে— যা নাগরিকদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ ছিনিয়ে নেওয়ারই অংশ। এটি বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়।’
২৪ ডিসেম্বর রিজভী আহমেদ পুনরুল্লেখ করেন, ‘আজকে প্রত্যক্ষভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসে খবরদারি করছে। তারা বড় গণতান্ত্রিক দেশ। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।’ ২৬ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশের পাতানো নির্বাচনের মদদদাতা ভারত।’
এর আগে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় করা কয়েকটি চুক্তির প্রতিবাদে সমাবেশ করে বিএনপি। ওই সমাবেশ ছিল অন্তত সাত-আট বছর পর বিএনপির প্রকাশ্য ভারতবিরোধিতা। ওই সমাবেশের পর আর প্রকাশ্য বিরোধিতা দেখা যায়নি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সম্প্রতি ভারতবিরোধিতা শুরু করার আগে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর তাগিদই ছিল বেশি।
২০২২ সালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে একান্তে আলাপ করেন বিএনপির একাধিক নেতা। এই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরের ১৬ মার্চে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির পাঁচ জন নেতাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন।
এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েকমাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত দুজন সদস্য দিল্লিতে গিয়ে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীকালে বিদায়ী বছরের নভেম্বর থেকে আবার ভারত-বিরোধিতায় ফেরে বিএনপি।
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে কাজ করেন, এমন একজন নেতার ভাষ্য— রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ্য ভারতবিরোধিতাকে ইস্যু হিসেবে ফিরিয়ে আনা, বা এ ধরনের কোনও কৌশল দলের শীর্ষনেতৃত্বে কাজ করে থাকলে প্রথমত স্পষ্ট করতে হবে— দলের অবস্থান প্রকৃতভাবে কে তুলে ধরবেন? বিএনপি যদি নৈতিকভাবে ভারতবিরোধিতাকে প্রাসঙ্গিক করে, তাহলে এর ব্যাখ্যা জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।
আরেক সদস্যের দাবি, ‘নতুন ইস্যু খোঁজার পেছনে পশ্চিমা কোনও দেশের পরামর্শও থাকতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের ভাষ্য, ‘সরাসরি ভারতবিরোধিতার সিদ্ধান্ত আসার পেছনে স্থায়ী কমিটির নতুন মেরুকরণই দায়ী। দলে এখন যারা স্টিয়ারিংয়ে আছেন, তারাই ইস্যু করার উপায় খুঁজছেন এবং ডানপন্থী শক্তিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছেন বিএনপিকে চাপ প্রয়োগ করতে। তবে বিষয়টি অন্য সহযোগী দলগুলো কীভাবে নেয়, সেটিও বিবেচ্য।’
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘এটা তো খুবই পরিষ্কার যে, ভারত একতরফাভাবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের অনেক বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন। বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার— ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তারা এটি করেছে। এখানে তাদের পরামর্শ ও চাপের বিষয়টি তো পরিষ্কার। এটা তো বলার কোনও প্রশ্নই রাখে না। তারা ইনটারফেয়ার করছে। জনগণের নির্বাচন, জনগণের ভোটে ঠিক হবে কে ক্ষমতায় যাবে। এটা তো দিল্লির ওপর নির্ভর করে না।’
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, শনিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রকাশ্যে নির্বাচনে মানুষ ভোট দেয়নি এবং একে বিজয় হিসেবে দেখানো হলেও নেতারা চাইছেন, আরও কী কী কৌশল নির্ধারণ করা হলে আন্দোলনকে একটি মাত্রায় নেওয়া সম্ভব হবে।
মঞ্চের একজন নেতার মন্তব্য, ‘আমাদের আগে অ্যাসেস করতে হবে। আন্দোলন কোথায় যাবে, তা বলা যাবে না। সাত তারিখের আগে কতদূর নিতে পেরেছি? এটা সরকারও জানে।’
এই নেতা ইঙ্গিত দেন, কেবলমাত্র কর্মসূচি দিলেই সরকার পড়ে যায় না। আলোচনা শুরু হয়েছে। উভয়পক্ষের নেতারা আন্তরিকভাবে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাচ্ছেন।
বিএনপির কোনও কোনও দায়িত্বশীল জানান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মুক্তি পাওয়ার আগে সুনির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে যাবে না বিএনপি। আলোচনার মধ্য দিয়ে তার মুক্তির জন্যও বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব অপেক্ষা করছেন, এমন দাবিও করেন কেউ কেউ।
শনিবারের বৈঠক সম্পর্কে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘অত্যন্ত আন্তরিক, উষ্ণতার মধ্য দিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে।’
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ‘যুগপৎ আন্দোলনে দল ও জোটের সক্রিয় ভূমিকাকে বিএনপি দলের সব স্তরের নেতাকর্মীরা কখনও ভুলবে না’ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো হয়। তবে যুগপৎসঙ্গী কয়েকটি দলের অনুযোগও ছিল বিএনপির বিরুদ্ধে।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের মন্তব্য, ‘এবারের আন্দোলন যুগপৎ ধারায় হলেও এর নেতৃত্বে বিএনপি ছিল। এতে বিএনপির নেতৃত্বের কৌশলের ঘাটতি ছিল। অ্যাকশন প্ল্যানে গ্যাপ ছিল।’ বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়গুলো তাদের জানানো হয়েছে বলে জানান নুর।
তিনি বলেন, ’৯০ ভাগ মানুষ ভোট দেয়নি। সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমন সরকারকে মেনে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নাই। পাঁচ বছর এই সরকার পার করলে দেশে কার্যত বিভিন্ন ফরম্যাটে বাকশাল কায়েম হবে। গণতন্ত্রের সংগ্রাম চালাতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম এবং যারা এককভাবে মাঠে ছিল— তারা সবাই নির্বাচন বর্জন করেছি, তারা সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা করছি।’
‘শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে, সে কারণে দেশের মানুষের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকেও কীভাবে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার দিকে আনা যায়, সে আলোচনাও আছে। সবচেয়ে বড় কথা— দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন টেনে নেওয়া কঠিন, সংক্ষিপ্ত সময়ে কীভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করছি।’ বলেন নুর।
‘কবে থেকে কর্মসূচি দেবো, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। শুরু হয়ে যাবে।’ বলছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একজন সেলিমা রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা এবং দেশব্যাপী হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। তাদের মুক্তির আশা করছি। আমরা শিগগিরই আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবো।’