“শীত খুব অতিরিক্ত পড়ছে দুইদিন থিকা। শীতের মইদ্দে কাজকাম কম। প্যাসেঞ্জার কম, তাই আয়ও কম, সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে”, বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার ভ্যানচালক ফরজ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিয়ে শুক্রবার এই জেলাটিতেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সঙ্গে ছিল কিশোরগঞ্জও।
একইদিনে ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে যথাক্রমে ২২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কয়েকটি জেলা বাদে কোথাও শৈত্যপ্রবাহ না চললেও প্রচণ্ড শীতে ঢাকাসহ সারাদেশেই জনজীবন পর্যুদস্ত। আবহাওয়াবিদরা বলছেন পুরো জানুয়ারিজুড়েই শীতের প্রকোপ থাকবে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস
আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকলেও আগামী তিনদিন আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এসময় মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা দুপুর পর্যন্তও থাকতে পারে।
কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে শুক্রবার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধিসহ দেশের কোথাও কোথাও দিনে ঠান্ডা পরিস্থিতি থাকতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
এত শীতের কারণ কী?
“সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। কিন্তু পার্থক্য যদি পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে তবে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। অর্থাৎ হাড়কাঁপানো শীত অনুভূত হয়” বলেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
শুক্রবার বিভিন্ন জেলার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তুলনা করে দেখা গেছে রংপুর, দিনাজপুর, তেতুলিয়ার মতো উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চলেই তাপমাত্রার পার্থক্য পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম।
এছাড়া ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলেও তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম।
বেশিরভাগ জেলাতেই সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়াতে শীতের অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কোথাও কোথাও তা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বলে জানান মি. মল্লিক।
নিয়ম অনুযায়ী, তাপমাত্রা আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। আর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
আপাতভাবে কিশোরগঞ্জ, ঈশ্বরদী ও চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রাই কেবল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আছে। তবে শীতের তীব্রতা সারাদেশেই অনুভূত হচ্ছে।
বাতাসের গতিবেগ
বাংলাদেশে কোনদিক থেকে বাতাস প্রবেশ করে এবং সেই বাতাস কতটা ঠান্ডা তার ওপর শীতের অনুভূতি নির্ভর করে।
পাশাপাশি যেসব অঞ্চলে বাতাসের চাপ বেশি থাকে বা বাতাসের উচ্চচাপ বলয় সক্রিয় থাকে, সেসব অঞ্চল থেকে বাতাস কম বায়ুচাপ এলাকায় প্রবাহিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশজুড়ে উচ্চচাপ বলয় তথা বাতাসের চাপ বেশি থাকার কারণে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে শীতের ঠান্ডা বাতাস উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় শীতের অনুভূতি তীব্র হচ্ছে বলে জানান মি. মল্লিক।
যেহেতু পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিবঙ্গজুড়ে উচ্চচাপ বলয় সক্রিয় আছে, ফলে বায়ুচাপ বাংলাদেশের দিকে প্রবেশ করছে।
“বাতাসের গতিবেগ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি থাকার কারণে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল ও খুলনার ওপরের দিকে যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা- এসব অঞ্চলে শীতের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে”, বলেন এই আবহাওয়াবিদ।
এছাড়াও ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাস খুব ঠান্ডা হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘জেড স্ট্রিম’ বা প্রচণ্ড গতিবেগ সম্পন্ন বাতাস কখনো নিচে নেমে আসছে, কখনো উপরে উঠে যাচ্ছে, যেটা ভাইব্রেট (কম্পন) হচ্ছে।
অর্থাৎ ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাসের নিম্নমুখী বিচরণ হচ্ছে। এই নিম্নমুখী বিচরণও অনেক সময় শীতের অনুভূতিকে বাড়িয়ে দেয় বলে জানান মি. মল্লিক।
কুয়াশা
শীতের তীব্রতার আরেকটি কারণ কুয়াশা।
মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন থেকে অতিঘন কুয়াশা থাকে।
রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটের মতো অঞ্চলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই কুয়াশা বিকেল পর্যন্তও থাকে।
এতে করে দিনের বেলা অতি ঘন কুয়াশার স্তর ভেদ করে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করতে পারে না।
এদিকে এসময় সূর্যের কিরণকালও থাকে কম।
উল্লেখ্য, সূর্য ওঠার দুই ঘণ্টা পর থেকে সূর্য ডোবার দুই ঘণ্টা আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় কিরণকাল।
মি. মল্লিক বলেন, “স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা”।
“ফলে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় মাটি শীতল থাকে এবং তীব্র শীত অনুভূত হয়”।
শীত কতদিন থাকবে?
পুরো জানুয়ারি মাসজুড়েই শীতের অনুভূতি থাকবে বলে জানিয়েছেন মি. মল্লিক।
তবে ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারির দিকে দেশজুড়ে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বাতাসসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস করা হয়েছে।
এই বৃষ্টিপাত থেমে গেলে তাপমাত্রা কমে গিয়ে ২০ তারিখের পরে মৃদু বা মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ আবার শুরু হতে পারে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মি. মল্লিক।
“ঠান্ডার মধ্যে বেশিক্ষণ গাড়িও চালাইতে পারি না”
শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় এই মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় সাংবাদিক আকবর মানিক জানান, প্রচণ্ড শীতে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত। সকাল ১২টা পর্যন্ত সেখানে রোদ ওঠেনি।
অনেকটা একই অবস্থা রংপুরেও।
সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক শাহরিয়ার মিম জানান, রংপুর অঞ্চলে গেল কয়েকদিনে হাড়কাঁপানো শীত শুরু হয়েছে।
একইসঙ্গে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে বেড়েছে শীতের তীব্রতা।
জেলাজুড়েই ঘন কুয়াশার দাপট অব্যাহত আছে। ফলে যানবাহনগুলোকে দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
শীতের কারণে সাংসারিক এবং অফিসের কাজে বিঘ্ন ঘটছে বলে জানান চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা ও এনজিওকর্মী কানিজ সুলতানা।
“কাপড় কেঁচে দিলে শুকানোর সুযোগ নেই। অন্যদিকে কুয়াশার কারণে অফিসে যাওয়ার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও অটো পাচ্ছি না। প্রতিদিন লেট হচ্ছে”, বলেন তিনি।
তবে বরাবরের মতোই প্রচণ্ড ঠান্ডায় সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নিম্ন আয়ের মানুষ।
“ঠান্ডার মধ্যে কাজ করতে ভালো লাগছে না। কিন্তু কাজ না করলেতো সংসার চইলবে না, বলেন একই জেলার মি. আশিক। পেশায় তিনি একজন রাজমিস্ত্রী।
রংপুরের রিক্সাচালক মো. সুজা মিয়া বলেন, “আজকের ঠান্ডা অতিরিক্ত ঠান্ডা। ঠান্ডার জন্য বের হতে চাচ্ছিলাম না। তারপরও সংসারের কষ্ট হবে কয়ে বাড়ালাম”।
“আমাদের রিকসা এখন তেমন কোন ভাড়াও নাই। কামাইও করতে পারি নে। সারাদিনে তিন-চারশো, পাঁচশো টাকা কামাই করতে আমাদের রাত হয়ে যায়। এই টাকা দিয়েতো সংসার চলে না। ঠান্ডার মধ্যেতো বেশিক্ষণ গাড়িও চালাইতে পারি না”।