জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তার আগে শেষ হয়েছে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা। তবে দুটি আসনে এখনো সম্পন্ন হয়নি নির্বাচন প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন প্রত্যাশীরা। শুধু দলীয় নয়, এবার স্বতন্ত্র জোটের মনোনয়ন পেতেও জোর তদবিরে নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের পদধারী, ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী, উদ্যোক্তা, অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন মাধ্যমের তারকারা। একাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী এমপিরাও পদ ধরে রাখতে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বর্তমানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৫০। অতীতে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীরাই এই পদে নির্বাচিত হতেন। তবে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী আনুপাতিক হারে এই আসনগুলো বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য থাকলে ওই দল সংরক্ষিত নারী আসনে একজন সংসদ সদস্য পদ পাবে।
অবশ্য নির্দিষ্ট দলের জন্য সংরক্ষিত নারী আসনে ওই দলের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে শুধু ওই দলের নির্বাচিত এমপিরা ভোট দিয়ে সংরক্ষিত আসনের সদস্য নির্বাচিত করবেন। যদিও গত এগারোটি সংসদের কোনোটিতেই সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। সেই ধারাবাহিকতায় এবারো যারাই ক্ষমতাসীন দল কিংবা স্বতন্ত্র জোটের জন্য নির্ধারিত আসনে একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন, তারাই বিনা ভোটে নির্বাচিত হবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২টি, জাতীয় পার্টি ১১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, জাসদ ১, কল্যাণ পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়লাভ করেছেন। সেই হিসাবে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৩৭টি নারী আসন পাবে। জাতীয় পার্টি পাবে দুটি। আর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মিলে ১১ জন নারী সদস্যকে নির্বাচিত করতে পারবেন। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সবাই বা একাংশ অন্য কোনো দলকে সমর্থন দিলে সে অনুপাতে আসন পাবে ওই দল।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোও ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে। আইন অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের ফলের গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। গত ৯ জানুয়ারি বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশিত হওয়ায় আগামী ৮ এপ্রিলের মধ্যে সংসদের সংরক্ষিত আসনের ভোট করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
আইন অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা শপথ গ্রহণ করেছেন, তাদের তথ্য তিন কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে। আর নির্বাচিতদের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে দল বা জোটগুলো বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের অবস্থান নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন। আর গেজেট হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের রাজনৈতিক দল বা জোটওয়ারী পৃথক পৃথক তালিকা প্রস্তুত করবে। আসন বণ্টন বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের জন্য কোনো নির্ধারিত নির্বাচনী এলাকা নেই। তারা কেবল দলীয় বা জোটের সদস্য হিসেবে পরিচিত হবেন। এক্ষেত্রে দল বা জোটের প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে নারী আসন বণ্টিত হবে।
জানা গেছে, দলীয় ও স্বতন্ত্র জোটের মনোনয়ন নিয়ে শুরু হয়েছে নানা হিসাবনিকাশ। এক্ষেত্রে সদ্য সমাপ্ত সংসদের নারী এমপিদের অনেককে বাদ দিয়ে আনা হতে পারে নতুন মুখ। বর্তমান নারী এমপিদের আমলনামা এখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হাতে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নারী নেত্রীরা গণভবনে যাওয়া-আসা বাড়িয়ে দিয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তারা।
ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭১ জন এমপিকে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে যে সংস্কার শুরু হয়েছে, সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রেও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। টানা চতুর্থবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভায় দলীয় নেতাদের যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, সেভাবে সংরক্ষিত নারী আসনেও পরিবর্তন আনতে পারেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদের কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তা, নানা বিতর্ক ও অদক্ষতার কারণে এবার সংরিক্ষত এমপির অনেকে বাদ পড়বেন। ক্লিন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী, জেলা পর্যায়ে ত্যাগী নেত্রী সরাসরি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েও জোটগত সমঝোতার কারণে যারা সরে দাঁড়িয়েছেন কিংবা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নানা হিসাবনিকাশে যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের এবার বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া প্রতিবারের মতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আলোকিত নারীদের সংরক্ষিত আসনে এমপি করা হতে পারে। এ ছাড়া যেসব জেলা থেকে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত আসনে কেউ এমপি ছিলেন না, সেসব জেলার সম্ভবনাময় নারী নেত্রীদের কপাল খুলতে পারে। একই সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমের তারকাদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হতে পারেন।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সাবেক সদস্য এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী আমেনা কোহিনুর বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মাঠে এবং তৃণমূলে কাজ করছি। দশম, একাদশ, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। সংরক্ষিত আসনেও মনোনয়নপত্র কিনেছিলাম, এবারও কিনব। বাকিটা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবেচনার বিষয়।’
দলীয় সূত্র জানায়, দ্বাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনের জন্য কমিশন তপশিল ঘোষণা করবে। সেই ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রির কার্যক্রম শুরু করবে। কয়েক দিনব্যাপী মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমাদান শেষে দলীয় সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় চূড়ান্ত হবে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীদের নাম। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত ৪৩টি নারী আসনের বিপরীতে ১৫১০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কেনেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪১ আসনে দলীয় একক প্রার্থী মনোনীত করে বাকি দুটি আসন ১৪ দলের শরিকদের জন্য ছেড়ে দেয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ কবে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণা করার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রির কার্যক্রম শুরু করা হবে।’