হাজার কোটির শাহ আলীর মাজারে প্রভাবশালীদের লুটপাট

জমি দখল করে রাজনৈতিক কার্যালয়

ঢাকা-১৪ আসনে যিনিই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, প্রথমেই তার নজর পড়ে হযরত শাহ আলীর মাজারের দিকে। কারণ এ মাজারকে ঘিরে নিয়মিত চলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য, যা এখানকার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে অনেকেরই অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব পর্যায়ের স্থানীয় নেতারা মাজারের সম্পদ লুটপাটে জড়িত। প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের ভাই হিসেবে পরিচিত জেপির (মঞ্জু) এক প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন এই দখলদারিত্বে। মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে চলে এই লুটপাট। এ ছাড়া ওয়াকফ কর্মকর্তারাও এতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট নথিপত্র অনুযায়ী, রাজধানীর বৃহত্তর মিরপুরের উত্তর বিশিল এলাকায় অবস্থিত হযরত শাহ আলী বাগদাদীর (র.) মাজার। আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত শাহ আলী থানার নামকরণও হয়েছে এই মাজারের নামে। মাজারের মোট জমির পরিমাণ ৩২.১৪ একর বা ৯৭.৪০ বিঘা। এর মধ্যে মাত্র ৫.৭৬ একর জমি মাজার শরিফের দখলে আছে বলে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি দাখিল করা মিরপুর ভূমি অফিসের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে।

যদিও মাজারের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার মোর্শেদ বলছেন, তাদের জমির পরিমাণ ২৭.৭৭ একর। তার হিসাব সঠিক হলেও ভূমি অফিসের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী মাজারের প্রায় ২২.০১ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। মিরপুর ভূমি অফিসের তথ্যমতে, শাহ আলীর মাজারের আশপাশের এলাকায় জমি শতাংশ প্রতি ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। আর প্রতি শতাংশ ৬০ লাখ করে ধরলেও ২২.০১ একর বা ২২০১ শতাংশ জমির দাম প্রায় ১ হাজার ৩২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

সরেজমিন পরিদর্শনে মাজারের বেদখল হওয়া এসব জমিতে বহুতল ভবন, স্থানীয় সাংসদের রাজনৈতিক কার্যালয়, কাঁচা বাজার, বিপণিবিতান, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ৪টি মার্কেট, ফলের আড়ত, স মিলসহ হাজারখানেক স্থাপনা দেখা গেছে। এই দখলের শুরু হয় প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য আসলামুল হকের সময়। বর্তমানে এই দখলদারিত্বে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সদ্য সাবেক সাংসদ আগা খান মিন্টু। তিনি বর্তমান মাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি। গত ১৮ নভেম্বর ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কমিটি গঠন করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা জেলার অধীনে এক সময় কেরানীগঞ্জ, এরপর তেজগাঁও এবং সর্বশেষ মিরপুর থানাধীন বিশিল মৌজায় ১৯.৫২ একর, ছোট দিয়াবাড়ী মৌজায় ৪.৩৫ একর জহুরাবাদ মৌজায় ১.০৫ একরসহ তিনটি মৌজায় মোট ২৪.৯২ একর জমি তৎকালীন সরকার থেকে ১২/১৯৬১-৬২ নং এল এ কেসের মাধ্যমে হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) মাজার শরিফের নামে ওয়াকফ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন ওয়াকফকৃত আরও ৭.২২ একর বা ২১.৮৮ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে বলে আদালতে দায়ের করা একটি রিট পিটিশনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২২ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ওই রিট পিটিশন নম্বর ১৫৩৮৭। এই জমি তাজউদ্দিন খান নামের এক ভক্ত মাজারের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। অ্যাকুজিশনের শর্ত অনুযায়ী এসব জমি মাজার উন্নয়ন ও বিশ্বমানের ইসলামিক কালচারাল সেন্টার নির্মাণসহ ধর্মীয় ও জনহিতকর কাজে ব্যবহার করতে হবে। তবে এসব শর্ত খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে যে যার খেয়াল খুশিমতো জমি দখল করে তৈরি করছেন বিভিন্ন স্থাপনা। আর এসব কাজে সহযোগিতা করছেন মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। মাজারের ম্যানেজার মোর্শেদ তাদের অন্যতম বলে অভিযোগ সেখানকার কর্মচারীদের।

সরেজমিন হযরত শাহ আলী মাজার এলাকায় দেখা গেছে, বিপরীত পাশে মাজারের জমি দখল করে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় বানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মাজার কমিটির সভাপতি আগা খান মিন্টু। এ ছাড়াও মাজারের জমিতে নির্মিত ফলের আড়তের অন্তত চারটি দোকান দখল করে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এসব দোকান কিনেছেন সামসু কসাই নামের এক ব্যক্তি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার বিকেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আগা খান মিন্টুর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে ফোন করা হলে সব অভিযোগ শুনে ‘এগুলো তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ মন্তব্য করে লাইন কেটে দেন। এরপর বারবার ফোন করা হলেও তিনি আর ধরেননি।

মাজার কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এম এ সেলিম খান মাজারের জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ‘হাজী সেলিম খান মার্কেট’। দোতলা সেই মার্কেটের নিচতলায়ই রয়েছে অন্তত ৫০টি দোকান। প্রতিটি দোকানের মাসিক ভাড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক সাবিনা আক্তার তুহিনের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। এই মার্কেটের পেছনেই বিসমিল্লাহ ইন্টারট্রেড নামের আরও একটি তিনতলাবিশিষ্ট গার্মেন্ট ভবন চোখে পড়েছে। সেলিম খানের ছেলে নাবিল খানের বাসাও এই ভবনে। মার্কেটের আরেক পাশে মাজারের পুকুর পাড় ঘেঁষে একটি সরু রাস্তা কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গেছে। এই রাস্তার দুপাশ ঘিরেই রয়েছে প্রায় দুই ডজন ছোট-বড় দোকান। এ ছাড়া সড়কের মাথায় অন্তত ৫টি ছোট-বড় স মিল (কাঠের কারখানা) দেখা গেছে। এসব দোকান আর স মিল থেকে মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ভাড়া উত্তোলন করা হয়। এসব ভাড়ার টাকা যায় মাজার কমিটির সদস্য সেলিম খানের ছেলে নাবিল খান এবং স্থানীয় ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাসুদ খানের পকেটে। নাবিল খান দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিনের বোনজামাই।

এসব বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার বিকেলে নাবিল খানের ২৫৫, দ্বিতীয় কলোনি, মাজার রোডের অফিসে গিয়ে দেখা করা সম্ভব হয়নি। ভেতরে এই প্রতিবেদকের ভিজিটিং কার্ড পাঠালে তিনি ব্যস্ত থাকায় দেখা করতে পারবেন না বলে জানানো হয়। এরপর তার মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দিলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

নথিপত্র অনুযায়ী কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে দিয়াবাড়ী মোড় পর্যন্ত পুরো জমি শাহ আলীর মাজারের। এখানেই প্রায় দশ একর জমি রয়েছে। এই জমি মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান মাজারের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তবে সরেজমিন দেখা যায়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে দিয়াবাড়ী ঘাটে যেতে হাতের বাঁ পাশে প্রায় ৩০টির মতো দোকান রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে হোটেল রিলাক্স নামের একটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এরপর পুরোনো একটি কাঁচাবাজার। এই বাজারে ৯০ থেকে ১০০টি দোকান রয়েছে। এরপর রয়েছে নবনির্মিত টিনশেডের একটি পাইকারি ফলের আড়ত। এ আড়তে ৫ শতাধিক দোকান রয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কালবেলাকে জানান, প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হক মাটি ফেলে এখানে কাঁচাবাজার ও ফলের আড়ত তৈরি করেন। আসলামুল হকের বিরুদ্ধে এখানকার দোকানপ্রতি ৩ লাখ করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে ৫০০ থেকে ৬০০ ছোট-বড় দোকান রয়েছে। আসলামুল হকের মৃত্যুর পর এগুলো দেখাশোনা করেন জেপির (মঞ্জু) প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল ইসলাম বেবু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ফলের আড়তের কার্যক্রম পরিচালনায় গড়ে উঠেছে একাধিক ব্যবসায়ী সমিতি, যার মধ্যে রয়েছে মিরপুর কাঁচামাল ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি, শাহ আলী (রহ.) আড়ত মালিক ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি, সুলতানুল শাহ আলী বাগদাদী আড়ত মালিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, তেজগাঁও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ও কারওয়ান বাজার সমিতি। এই মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পেতে হলে ধরনা দিতে হয় এসব সমিতির নেতাদের কাছে। এই প্রতিবেদক ব্যবসায়ী পরিচয়ে মিরপুর কাঁচামাল ব্যবসায়ী বহুমুখী সবমায় সমিতির পরিচালক মো. এখলাস উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে দোকান বরাদ্দের বিষয়ে যোগাযোগ করেন। এ সময় তিনি দোকানভেদে ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন।

তিনি জানান, ‘পজিশন এবং স্কয়ার ফুট হিসেবে নির্ধারিত হয় দোকানের মূল্য। এখানে ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত মূল্যের দোকান রয়েছে।’

গড়ে ৪০ লাখ টাকা করে ধরলেও ৫০০ দোকান থেকে অন্তত ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এসব সমিতির নামে। এ রকম দুটি সমিতির নেতাদের তালিকা কালবেলার হাতে রয়েছে।

শাহ আলীর মাজারের উত্তর পাশে কলেজ মার্কেট। এই মার্কেটে তিনটি ফ্লোরে সর্বমোট ১২০০ দোকান রয়েছে। এই মার্কেটে দোকানপ্রতি ভাড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। মাসে ১০ হাজার টাকা করে ধরলেও এখান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া ওঠে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। তবে এই মার্কেট মাজার কর্তৃপক্ষের দখলে নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা মাজার কর্তৃপক্ষকে ভাড়া দেন। আবার মাজারের ম্যানেজার মোর্শেদ বলছেন, এই মার্কেট তাদের না। এই মার্কেট শাহ আলী মহিলা কলেজ কর্তৃপক্ষের। কলেজ মার্কেটের পরই রয়েছে মাইজভান্ডারির আস্তানা। এরপর ফাইয়ুয়ি ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্ট কোম্পানি। এই গার্মেন্টের মালিক আকবর হোসেন। একটু সামনে গেলেই কবরস্থান। এরপর অন্যপাশের জমিও নথি অনুযায়ী মাজারের। মাজারের পেছন থেকে উত্তর বিশিলের দুই নম্বর রোড পর্যন্ত পুরো জমি মাজারের নামে ওয়াকফকৃত। তবে এসব জমিতে টিনশেড থেকে শুরু করে ৮-৯ তলাবিশিষ্ট একাধিক বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৭৯ সালে অ্যাওয়াজ বদলের মাধ্যমে হাউজিং সেটেলমেন্ট বিভাগ থেকে এসব জমির মালিকানা পায় শাহ আলী মাজার। এখানে মোট জমির পরিমাণ ২.১৮ একর, যার পুরোটাই বেদখল।

মাজারে মাদকের হোতা সহকারী ইনচার্জ মিজান:

শাহ আলীর মাজারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। এই মাদক সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে মাজারের ফরাস সহকারী ইনচার্জ মো. মিজান খান। জানা যায়, এক সময় মিজান শাহ আলীর মাজারের সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিল। এরপর ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ১০০ বোতল ফেনসিডিলসহ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হন। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির দারুসসালাম থানায় একটি মাদক মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং-২৪, তারিখ : ২২-৯-২০১১। এ ঘটনায় সে মাজারের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি হারান। এরপর ২০২২ সালে তাকে সিকিউরিটি গার্ড থেকে প্রমোশন দিয়ে ফরাজ সহকারী ইনচার্জ হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়। বর্তমান মাজার পরিচালনা কমিটি ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে ফের চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্তে ওয়াকফ প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হলেও অদৃশ্য কারণে সেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

আয়-ব্যয়ের হিসাবেও ‘গরমিল’:

এমপি থাকাকালে শাহ আলী মাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের হাতে। এ সময় অন্তত ১০ বছরের কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব দেননি তিনি। আসলামুল হকের মৃত্যুর পর আগা খান মিন্টু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি মাজার কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। এরপর আসলামুল হকের পথে হাঁটেন মিন্টুও। তার সময়ের তিন বছরেরও কোনো হিসাব নেই মাজার কমিটির কাছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করানোর কথা থাকলেও সেটি করা হয় না। মাজার কমিটির যোগসাজশে গত ১৩ বছরে কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাজারের পুরোনো কর্মচারীরা। এসব আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মাজারের ম্যানেজার মোর্শেদ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার দুপুরে শাহ আলী মাজারের প্রশাসনিক ভবনে গেলে পাওয়া যায় ম্যানেজার মোর্শেদকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা।’

মাজারের জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, মাজারের কোনো জমি বেদখল নাই। বিআইডব্লিউটিএ কিছু জমি দখল করেছে। এ ছাড়াও সব জমি তাদের দখলে রয়েছে।

এরপর মিরপুর ভূমি অফিসের প্রতিবেদন দেখানো হলে তিনি বলেন, ‘ওই প্রতিবেদন ভুয়া।’

প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিতে মিরপুর ভূমি অফিসে গেলে মিরপুর সার্কেলের ভূমি সহকারী কমিশনার অর্ণব মালাকার প্রতিবেদন সঠিক বলে জানান। এরপর তিনি ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ গরীব শাহকে বিষয়টি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে বলেন। মুহাম্মদ গরীব শাহ প্রতিবেদনের স্মারক নম্বর থেকে ২০২২ সালের রেজিস্টার খাতা দেখে প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

পরে এ বিষয়ে মাজারের ম্যানেজারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বলেন, তারাও তাদের জমিজমা নিয়ে ওয়াকফকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। এই প্রতিবেদক সেটি দেখতে চাইলে তিনি দেখাননি। অডিটের বিষয়ে ম্যানেজার মোর্শেদ বলেন, নিয়মিত অডিট হয়। তবে অডিট প্রতিবেদনে দেখতে চাইলে তিনি তাও দেখাতে পারেননি। এরপর কাঁচাবাজার ও ফলের আড়তের বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজারের পাশেই বসে থাকা অফিস সহকারী পরিচয় দানকারী একরামুল বাসিত বলেন, ‘৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা করে চারটি ক্যাটাগরিতে ওই জমি আমরা তিনটি সমিতিকে ভাড়া দিয়েছি।’

ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জমি ভাড়া দিলেন কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়াকফ আমাদের দেখভাল করে। পরিচালনার দায়িত্ব মাজার কমিটির। মাজার কমিটিই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

জানতে চাইলে ওয়াকফ মিরপুর অঞ্চলের ইন্সপেক্টর মামুনুর রশিদ বলেন, ‘কে কী অভিযোগ দিল—এটা তো বিষয় না। যারা অভিযোগ দিয়েছে তারা তাদের স্বার্থেই অভিযোগ দিয়েছে। আমাদের কিছু জমি পানি উন্নয়ন বোর্ড দখল করেছে। এ ছাড়া কোনো জমি দখলে নেই।’

মিরপুর ভূমি অফিসের প্রতিবেদন দেখালে তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদন আমিই জরিপ করে তৈরি করতে বলেছি। তবে এই প্রতিবেদন এখনো আমি পাইনি।’ অনিয়মের সঙ্গে তার নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করলে তো আমি বলবই, আমি কিছু করি নাই। আপনি পারলে তদন্ত করে বের করেন। আপনারা পারবেন আমাদের সঙ্গে, আমাকে নরম পাইছেন। ওখানে যে এমপি কাউন্সিলররা রয়েছেন তাদের সঙ্গে তো পারবেন না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে গত বুধবার ওয়াকফ প্রশাসক আবু সালেহ মো. মহিউদ্দিন খার অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ওয়াকফ প্রশাসকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শাহ আলী মাজার ওয়াকফের হলেও ওখানে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে আসলাম সাহেব থাকতে তো ওখানে যাওয়াই যেত না। এরপর মিন্টু সাব এমপি হওয়ার পর তিনি তার মতো করে চালান।’

(কালবেলার প্রতিবেদন থেকে)

Exit mobile version