হতাশা বাড়ছে জাতীয় পার্টিতে। সমঝোতার ২৬ আসনসহ কয়েকটি আসনে দলটি লড়াই করলেও বাকিগুলোতে নেই প্রচার-প্রচারণা। একে একে সরে যেতে শুরু করেছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। গুঞ্জন আছে দলটির আরও অনেক প্রার্থী একযোগে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন। নির্বাচন প্রত্যাহার করা প্রত্যেক নেতাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন শীর্ষ নেতাদের প্রতি। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন।
গতকাল নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন হবিগঞ্জ-২ আসনের (বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ) জাতীয় পার্টির প্রার্থী শংকর পাল। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে থাকা না থাকা একই কথা। তারা ২৬ আসন নিয়ে খুশি। তারা লিখছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তাহলে আমি কী সমর্থিত লিখবো।
নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব রয়েছে। আছে ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তির প্রভাব। আমি আমার কর্মী-সমর্থকদের কথা চিন্তা করে নির্বাচন থেকে সরে আসছি।
গত রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বরিশাল-২ ও ৫ আসনের দলীয় প্রার্থী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস এবং বরগুনা-১ আসনের প্রার্থী খলিলুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, নির্বাচন কমিশনের আচরণে মনে হচ্ছে তারা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। সরকার কিছু রাজনৈতিক দলকে ঘুষ বরাদ্দ দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে ৭ই জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
একই মঞ্চে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বরগুনা-১ আসনের জাতীয় পার্টির আরেক প্রার্থী খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিলাম। সরকারদলীয় নাটকে আমাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করায় নির্বাচন থেকে সরে যেতে হলো। আজ থেকে বরগুনা-১ আসনের নির্বাচন থেকে আমি সরে দাঁড়ালাম।
ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, আমি সমঝোতা হওয়া ভাগ্যবান ২৬ জনে নেই। তাহলে কার বিরুদ্ধে নির্বাচন করবো? যেখানে ফলাফল নির্ধারিত সেখানে আমি প্রচার-প্রচারণায় নামবো কেন? ২৬টি আসন ব্যতীত অনেক আসনেই এমন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
বরগুনা-১ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের দলের নেতারা লিখছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কেউ লিখছেন জোটভুক্ত। আমার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছে পাঁচজন, এদিকে আমি একা। আমি কার সঙ্গে লড়বো? আমি তো নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলাম। মানুষ বলে, ২৬ এর বাইরে তো আসন পাবেন না। তিনি বলেন, দল তো ২৬ আসন নিয়েই খুশি। বাকি আসন নিয়ে তো তাদের চিন্তা নাই। মানুষ বলে আপনারা ২৬টা আসন না নিয়ে নির্বাচনে গেলে আপনাদের ভোট দিতাম। এখন তো ভোট দিয়ে লাভ নাই। তাই এই নির্বাচন থেকে সরে এসেছি।
গত রোববারই নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন গাজীপুরে দুটি আসনে প্রার্থী হওয়া এমএম নিয়াজ উদ্দিন। গাজীপুর মহানগরের জাপা সভাপতি গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও সিটির একাংশ) ও গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ ও সদর একাংশ) আসন থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী। তিনি বলেন, সরকারের একতরফা নির্বাচন, সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যক্তিগত কারণে সরে দাঁড়িয়েছি। আমার সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও কোনো আলোচনা হয়নি। মূলত আমি আর পারছি না, যার কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।
গত সপ্তাহে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি আলাউদ্দিন মৃধা। এ সময় তিনি বলেন, মনোনয়ন-বাণিজ্যের কারণে নাটোর-১ ও নাটোর-২ আসনে দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে জেলা জাতীয় পার্টির সবাই একযোগে পদত্যাগ করবে।
গত ২২শে ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ-৩ (তাড়াশ-রায়গঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী জাকির হোসেন নির্বাচনে না লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচন প্রত্যাহার করার সময়ে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হয়ে গেছে, এখন আর নির্বাচন করে লাভ কী? আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হয়ে গেছে। সেখানে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন দেয়া হয়েছে। আমরা তো আর নির্বাচিত হতে পারবো না। আমাদের মনোবলও ভেঙে গেছে।
একইদিনে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী ও দলের যুগ্ম মহাসচিব ছালাউদ্দিন খোকা মোল্লা। তিনি বলেছিলেন, ব্যক্তিগত কারণেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়েছি। তবে দল আমাকে প্রত্যাহার করতে বলেনি। আমি নিজের সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। এ ছাড়াও নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ঢাকা ১৩ ও ১৪ আসনের প্রার্থী হয়েও প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন গত ১৭ই ডিসেম্বর।
জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, আমাদের দলটির অন্তত ৫০ জনসহ প্রায় ১০০ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার চিন্তা করছেন। অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কিংবা পরামর্শ চেয়েছেন। অনেকেই আছেন যারা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারছেন না। অনেকের ভয় আছে। কারণ আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানোর জন্য চায় আমরা মাঠে থাকি। যেহেতু নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে ভয় কাজ করছে তাই তারা একযোগে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছেন। যদি সবাই সম্মত হয় কিংবা পরিবেশ সৃষ্টি হয় তবে দু-একদিনের মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে চলে আসতে পারে।
এদিকে গতকাল নিজ নির্বাচনী আসন রংপুর-৩’এ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন না আসা পর্যন্ত সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবো কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। অনেক সময় অনেক প্রার্থী নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকেন না, কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ করেন, আবার কেউ ঘোষণা করেন না। কেউ এমনিতেই বসে যান।
তিনি আরও বলেন, পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে আমার একটা নির্দেশ আছে, যারা নির্বাচন করতে চান, করতে পারেন। নির্বাচন করতে না চাইলে সেটিও সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।