প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা কারো সঙ্গে দেশের স্বার্থ বেচে, মানবতার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা কখনো করেননি। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে লেগে আছে সারাক্ষণ। তাতে তার কিছু আসে যায় না। জনগণের শক্তিই হলো বড় শক্তি।
বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাত ৮টায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সম্প্রচার হওয়া লেটস টকে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নাতি-নাতনি বিদেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকায়, তাদের পাই না। আজ এক ঝাঁক নাতি-নাতনি পেলাম।’
স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে দেখতে পাই কম্পিউটার ও বিজ্ঞানের প্রতি কারও খুব আগ্রহ ছিল না। তাই আমি ক্ষমতায় এসেই কম্পিউটারের ওপর জোর দিচ্ছিলাম। আমরা লক্ষ্য পূরণ করে ফেলেছি। এখন দেশে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। দেশে ফোর-জি ব্যবহার হচ্ছে। ফাইভ-জিও চালুর প্রস্তুতি চলছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে ভাবার সময় আমার ছেলে (সজিব ওয়াজেদ জয়) বুদ্ধি দিলো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিজের দক্ষতা অর্জন করবে এবং শিক্ষা-জ্ঞানে ও প্রযুক্তিবিজ্ঞানে দক্ষ জনশক্তি হিসেব গড়ে উঠবে। পাশাপাশি সরকারেকেও স্মার্ট সরকার করতে হবে। আমি যখন প্রথমবার এলাম, দেখলাম কম্পিউটার সাজানো আছে, কিন্তু কেউ ছুঁয়ে দেখে না। এখন সবার হাতে হাতে এসব ডিভাইস আছে। সব ডিজিটাল করে দিলাম। আমি সরকারে আসার পর সবার জন্য মোবাইল ফোন উন্মুক্ত করে দিলাম। স্কুলে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করলাম। এখন সব জায়গায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারি সব কাজ ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। স্মার্ট সরকার হবে। পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতিও স্মার্ট হবে। সরকার ডিজিটালাইজড হলে আমাদের কর্মঘণ্টা বাঁচবে, যোগাযোগ ও যাতায়াতে সমস্যা হবে না। সেই সঙ্গে চাই আমাদের সোসাইটিও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করুক। এখন পেনশন থেকে শুরু করে সব কাজই অনলাইনে করতে পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিভিন্ন ভাতাও অনলাইনে দিয়ে দেই। গ্রাম-গঞ্জে একসময় কিছুই ছিল না। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে হতো। গত মাসে গিয়ে দেখি সবার হাতে মোবাইল ফোন। গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করে, টাকা উপার্জন করে। ফ্রিল্যান্সারদের টাকা তোলা নিয়ে সমস্যা হতো, সেটাও সহজ হয়ে গেছে। এখন টাকা তুলতে এ সমস্যা হয় না। করোনার সময়টা যত খারাপ সময় হোক একটা দিকে খুব ভালো হয়েছে, ডিজিটালাইজেশনের দরজাটা খুলে গেছে। আমি সব ধরেনের মিটিং ভার্চুয়ালি করলাম। ওই সময় ১৬০০-এরও বেশি সভা করেছি।’
‘২০৪১ সালে যে বাংলাদেশ হবে, সে সময় প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়েই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করবে। নতুন যত প্রযুক্তি আসবে, তারা শিখবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ অনুষ্ঠানের নাতিপুতিরা সব ভবিষ্যতে ৪১-এর কর্ণধার হবে,’ যোগ করেন শেখ হাসিনা।
তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে এক প্রশ্নে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি। নারী-পুরুষ আর তৃতীয় লিঙ্গ যেই হোক সবাই আমার সন্তান। প্রত্যেক পরিবার তাদের সন্তানকে বহন করবে। তারাও নিজের অধিকার নিয়ে সমাজে দাঁড়াবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত কাজ করবে। সেই অবস্থার সুযোগ করে দিয়েছি। সব মানুষ সমানভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, কাজ করবে আর জীবন উন্নত করবে, এটার নিশ্চয়তা আমরা দিতে চাই।’
পর্যটন খাত নিয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চা বাগান থেকে শুরু করে সমুদ্র সৈকত- আমাদের অনেক সম্পদ আছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমাদের কক্সবাজার। এ সৈকত ঘিরে উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। এখানে বিদেশি পর্যটক আনতে চাই। তাই বাইরের কোনো দেশকে একটা অংশ দেবো। তারা ইনভেস্ট করবে, পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য সেই অংশ উন্মুক্ত থাকবে। নেপালের সঙ্গে যৌথভাবে পর্যটন খাত উন্নত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। মালদ্বীপের সঙ্গে নৌভ্রমণের ব্যবস্থা করছি।’
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সম্পদ গ্যাস। ৯৬ সালে অন্য কোম্পানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও গ্যাস উত্তোলন করে। তবে তারা গ্যাসটা বিক্রি করার কথা বললে, আমি আপত্তি করি। এর খেসারতও আমাকে দিতে হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আমাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি।’
কিছু কিছু জিনিস আছে যারা সবসময় হস্তক্ষেপ করতে চায় মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে, শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা তোলে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তারা নিজেদের দেশের দিকে তাকায় না। জাতিসংঘে বক্তব্যে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আক্রমণের বিষয়ে তুলে ধরেছি। ইইউতেও শক্তভাবে তুলে ধরেছিলাম। সিকিউরিটি কাউন্সিলে যুদ্ধ বন্ধের যে উদ্যোগ নেয়া হলো সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিল। আমাদের দেশে মানবাধিকার খুঁজে বেড়ায় আর তাদের দেশে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের গুলি করে মারে, রেস্টুরেন্টে গুলি করে মারে। তাদের দেশের জীবনের নিশ্চয়তা নাই, কিন্তু তারা অন্যের দেশে খবরদারি করে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের ডেফিনেশনটা কী সেটাই আমরা এখনো বুঝতে পারলাম না। পুরো পৃথিবী বুঝতে পারেনি। এটাই বাস্তবতা।’
৪৫ শতাংশ নারী সন্তান জন্মদানের পর কর্মক্ষেত্র থেকে অব্যাহতি নেয়। সেসব নারীর সন্তানদের জন্য কম খরচে ডে-কেয়ারের সুবিধা আছে কি-না এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার করে দেই। বাচ্চাদের আনার জন্য বাসের সিট রিজার্ভ থাকে। প্রত্যেক প্রজেক্টে ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা বলা আছে। পোশাক খাতেও ডে-কেয়ার সেন্টার করা হচ্ছে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেও করে দিচ্ছি। মাতৃত্বকালীন ছুটি তিনমাস ছিল, যা এখন ছয় মাস করা হয়েছে। কর্মজীবী মায়েদের জন্য আলাদা ভাতাও দেই।’
জলবায়ুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকারে আসার পর জলবায়ু নিয়ে নিজস্ব ফান্ড করি। অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে কাজ করি। জলবায়ুর ডেমেজটা যাতে না হয় এর জন্য নীতিমালা করে দিয়েছি। উপকূলীয় অঞ্চলে সুবুজায়ন ও বৃক্ষ রোপণেরও উদ্যোগ আমাদের। কাজ করে যাচ্ছি। দেশে যাতে দুর্ভিক্ষ না দেখা দেয় এর জন্য আমদের এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখতে নিষেধ করেছি। যে যেভাবে পারেন উৎপাদন করবেন। যেন আমাদের কারো কাছে হাত পাততে না হয়। আমার গণভবনও কিন্তু রীতিমতো খামার বাগান। আমিও চাষ করি। গ্রামের বাড়িতে সব জমি পরিষ্কার করে ফসল ফলাচ্ছি। তরুণ সমাজের প্রতি আশা থাকবে, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। নিজেদের উৎপাদন নিজেদেরই করতে হবে।’
তথ্য প্রযুক্তিতে হ্যাকিং বন্ধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জন্য নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি সমস্যাও তৈরি করে। হ্যাকিং বন্ধে সাইবার সিকিউরিটি আইনও করে দিয়েছি। যাতে কেউ প্রযুক্তির অপব্যবহার করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া যায়। তবে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন থাকতে হবে।’
প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা দূর করা নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের জন্য এরইমধ্যে আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের চলাফেরা, র্যাম্পের ব্যবস্থা, লিফটের ব্যবস্থা, টয়লেটের ব্যবস্থাসহ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করছি। খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সংসদ ভবনের পাশে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের জন্য খেলার মাঠ করছি। সাভারে একাডেমি করে দিচ্ছি। ক্রিকেট টিমকে অনুদান দিয়ে আসছি।’
তরুণ সমাজকে হতাশা কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইদানীং দেখি তরুণদের মাঝে হতাশা ভাব কাজ করছে। আসল কথা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। নিজের কাছে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। একে অপরের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলতে হবে। সবাই এখন মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় বাইরের জগতটাকে ঢাকা পড়ে থাকছে। এজন্য হতাশা দেখা দেয়। নিজেকে ভালো রাখার চিন্তা মাথায় থাকলে হতাশা ধরবে না। তরুণদের এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়, তারা কেন হতাশ হবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ভাই-বোনে ঝগড়া করবে। তাহলেই দেখা যাবে হতাশা অনেকটা কেটে গেছে।’
নিজের মতো করে বাইরে খেতে যাওয়া হয় কি-না এমন প্রশ্নে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাইরে খেতে যেতে পারি না। সিকিউরিটির নামে বন্দি করে রাখে। বলতে পারবো না কোথায় কোন রেস্টুরেন্ট আছে। যেতে পারছি না, খেতেও পারছি না। নিরাপত্তা বলে বলে সব শেষ করে দেয়। তবে আমার নাতিপুতিরা রান্না পছন্দ করে। যা-ই রান্না করি তাদের ভালো লাগে। মোরগ পোলাও, মাছ, ইতালিয়ান পিজ্জা ও লেজানিয়া করি।’
দেশের জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সারাক্ষণ কাজের ফাইল আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এত পড়াশোনা স্কুলে করলে খালি ফার্স্ট হতাম। গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে। ম্যাগাজিন পড়তে ভালো লাগে। তবে ফাইলের কাজ করতে অনেক ঝামেলা।’
ভবিষ্যতে গ্রামে থাকতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম গ্রামে। আমার গ্রাম টুঙ্গীপাড়া। সেখানে নদী আছে। ঢাকা যেতে অনেক সময় লাগতো। রাজনীতির কারণে বাবাকে জেলে থাকতে হতো আমরা গ্রামেই ছিলাম। দাদা-দাদির সঙ্গে আট বছর ছিলাম। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় আসি। তবে প্রতি বছর গ্রামে যেতাম। তখন রাস্তাঘাট ছিল না, চারদিকে পানি ছিল। ওইটাই আমার ভালো লাগতো। ভবিষ্যতে আমি গ্রামেই থাকবো। এ জন্য ঢাকায় কোনো বাড়ি করিনি। গ্রামেই মজা।’
শেখ হাসিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য অনেক ছেলেমেয়েরই আছে। তবে দেশের জন্য তরুণকে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়া না। মানুষের উপকারে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এর আগে ২০০৮ সালে তরুণদের জন্য ‘দিন বদলের সনদ’ ইশতেহারের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। আর এবার তরুণদের কথা মাথায় রেখেই স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের কথা বলছেন তিনি।