নির্বাচনী প্রচারণায় বাড়ছে সহিংসতা, অভিযোগ করেও প্রতিকার নেই
- ১২৬ আসনে বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা
মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন আছে, কিন্তু তাদের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন
অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না। এ কারণে বাড়ছে সহিংসতা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণাকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেশি হচ্ছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে ভোটারদের মধ্যে। গত এক সপ্তাহে দেশের ১৪ জেলায় নির্বাচনি সহিংসতায় একজন নিহত হয়েছে। এছাড়া গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে অন্তত ৫৩ জন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি নির্বাচনি অফিসেও ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। আচরণবিধি মানা ও সহিংসতা রোধে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, একাধিকবার অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না। এ কারণে সহিংসতার ঘটনা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন রয়েছে। এত ব্যবস্থাপনা থাকার পরও মাঠ পর্যায়ে সহিংসতা ও আচরণবিধি অধিকাংশই মানা হচ্ছে না। কিন্তু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
প্রার্থীদের উভয়েরই রয়েছে খুঁটির জোর। সবাই দলের লোক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অনেকে ক্ষমতাধর। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ তাদের সাপোর্ট দেন। এই ধরনের চাপের কারণে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে পুলিশ। শক্তভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা। আবার একশ্রেণির পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা পক্ষপাতিত্ব করছেন। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান কমিটির দৃশ্যমান ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমন অবস্থার মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ১২৬ আসনে বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন। মাঠ পর্যায়ের এই রিপোর্ট লিখিতভাবে শীর্ষ প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার মতো ভয়ংকর সব খবর আসছে। এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, সারা দেশে সংঘাত-সহিংসতা ততই বাড়ছে। হামলা-ভাঙচুরের পাশাপাশি হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সাধারণ ভোটাররা আতঙ্কে ভোটকেন্দ্রে যাবে কি না, এটা এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাসের সমর্থক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ছয় জন আহত হয়। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী অনেক শক্তিশালী। গতকাল শরীয়তপুর-২ আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুই জন আহত হয়। নওগাঁর রাণীনগরে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৯ জন আহত হয়েছে। এদিকে একশ্রেণির স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে প্রচুর টাকা বিলি করছে। তাদের এত টাকার উৎস কোথায়—তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে নৌকার প্রার্থীর নাম উল্লেখ করে। কোনো কোনো আসনে বহিরাগত লোক ও খুনিদের নির্বাচনের প্রচারের কাজেও লাগানো হচ্ছে। আবার কিছু জায়গায় অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। নির্বাচনের মাঠে পক্ষপাতিত্ব ও সহিংসতা ঘটনা রোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে গতকাল পর্যন্ত দুই জন জেলা প্রশাসক, ছয় জন ওসি ও এক জন ইউএনওকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত দেয় নির্বাচন কমিশন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নাটোর-২ (সদর) আসনে নৌকার প্রার্থী শফিকুল ইসলাম শিমুলকে ভোট না দিলে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম মাসুম। মহান বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি নির্বাচনি আচরণবিধি ভেঙে স্বতন্ত্র প্রার্থী পক্ষে কাজ না করার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘কেউ নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করলে এমন জায়গায় মারব, কাউকে দেখাতে পারবেন না।’ এছাড়া যে বা যারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে এজেন্ট দিবে, তার বা তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করারও হুমকি দেন তিনি। তার এই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপসহ লিখিত অভিযোগ গত ১৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর জমা দেন নাটোর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আহাদ আলী সরকার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
যারা সহিংসতার সঙ্গে জড়িত, আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে আশঙ্কা করছেন মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা। কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর পূর্বের রাজনৈতিক ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে ছিলেন। সরকারবিরোধী চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। তারাও অর্থ দিয়ে সহিংসতা ঘটাতে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তারা নির্বাচনে একটি বিপজ্জনক হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। যদিও তাদেরকে মনিটর করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে লিখিত ও কমিশন সভা করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।