নির্বাচনবাংলাদেশ

জাতীয় সংসদ নির্বাচন: টাকা নিলে গ্রেপ্তার ভোটারও

জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে প্রার্থীদের মধ্যে ততই ছড়িয়ে পড়ছে উত্তাপ। একে অন্যকে ঘায়েল করতে রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছেন। সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ। এর মধ্যে প্রার্থীদের টাকা খরচও বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য পেয়েছে, ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনেই টাকার লেনদেন শুরু হয়েছে। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা গোপনে ভোটারদের টাকা দিচ্ছেন।

এই তথ্যের ভিত্তিতে নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে কয়েক দফা বিশেষ বৈঠক করেছেন সংস্থাগুলোর প্রধানরা। যেসব প্রার্থী টাকা বিলি করছেন এবং যারা গ্রহণ করছেন তাদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বার্তা পেয়ে তালিকা করার কাজ শুরু করেছে পুলিশের সবকটি ইউনিট। তালিকার কাজও প্রায় শেষ।

পুলিশের বার্তায় বলা হয়েছে, প্রার্থীদের কাছ থেকে যারা অর্থ নেবেন তাদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি প্রার্থীদের তাৎক্ষণিক সাজা দিতে হবে। এসব অপকর্মের নজরদারির পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় রাখার কথা বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন করছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচনে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। বিশেষ করে নাশকতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাছাড়া নির্বাচনে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। পুলিশ-র‌্যাবসহ সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশও কাজ করছে।

পুলিশ সদর দপ্তর মনে করছে, যেসব প্রার্থী বা তাদের পক্ষে যারা টাকা বিলাচ্ছেন এবং যারা টাকা নিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে বেশিরভাগ তথ্য কমিউনিটি পুলিশই সংগ্রহ করতে পারবে। এখনই প্রার্থী বা তাদের পক্ষের লোকজন ভোটারদের অর্থ দিয়ে প্রভাবিত করতে শুরু করেছেন বলে পুলিশ সদর দপ্তর নিশ্চিত হয়েছে। এমন তথ্য পাওয়ার পর কিছুদিন আগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ বৈঠকও করেছেন। ওই বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা বলেন, প্রায় সবকটি আসনেই প্রার্থীরা টাকা বিলি করছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। তথ্য পেয়ে তারা নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করেছেন। কমিশনের নির্দেশনা হলো যারা এসব অপকর্ম করছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

পুলিশের এ দুই কর্মকর্তা বলেন, প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিললেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ভোটারকে গ্রেপ্তার করা হবে। আর যেসব প্রার্থী বা তাদের লোকজন টাকা বিলি করবেন তারাও গ্রেপ্তার হবেন। টাকা নেওয়ার দৃশ্য গোপনে ভিডিও করতে প্রতিটি আসনের আনাচে-কানাচে পুলিশের লোকজন কাজ করছে।

জানা গেছে, সারা দেশে কমিউনিটি পুলিশের ৪০ হাজার ৯০৮টি কমিটিকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। কমিটির মোট সদস্য ৯৫ হাজার ৪ জন। তাদের দিয়েও প্রার্থী ও তাদের লোকজনের কর্মকা- গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুলিশ সূত্র বলছে, গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একাংশ) আসনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক। একই দল থেকে কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেলসহ আরও কয়েকজন প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। অভিযোগ উঠেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে দুজন নির্বাচিত হতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তার পক্ষে প্রচারে যোগ দিতে নানাভাবে বাধ্য করছেন। তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিচ্ছেন ভোটারদের প্রভাবিত করতে। সফিপুর, কালিয়াকৈর বাজারসহ ওই নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরেও একই তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নগদ টাকা ছড়িয়েছেন ওই প্রার্থীরা। বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন পেতে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনও করছেন বলে জানা গেছে। তাছাড়া ঢাকায় প্রায় সবকটি আসন, কুমিল্লার ১, ৩, ৫, ৭, ৮ নম্বর আসন, ফেনীর ১, ২ ও ৩ নম্বর আসনসহ অন্তত ২৯২টি আসনে প্রার্থীরা অর্থ লেনদেন করছেন। ভোটারদের এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।

অথচ নির্বাচন কমিশন মাসখানেক আগে একটি প্রজ্ঞাপনে বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা করে ব্যয় করতে পারবেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দানকারী রাজনৈতিক দল থেকে নেওয়া খরচসহ ২৫ লাখ টাকার মধ্যে থাকতে হবে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটারপ্রতি ব্যয় ১০ টাকা নির্ধারণ করেছিল ইসি। আইনে সর্বোচ্চ নির্বাচনী ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও বাস্তবে এটি কতটুকু মানা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button