এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি এখন মৃত্যুশয্যায়
জাতীয় রাজনীতি ও ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিলেন। রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কিছু কিছু অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যেও যে এরশাদের জনপ্রিয়তা ছিল তার প্রমাণ মেলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে।
তবে এরশাদের মৃত্যুর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনই তার দল জাতীয় পার্টির (জাপা) জন্য বড় পরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে।
যথারীতি নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এবারও নির্বাচনে এসেছে দলটি। কিন্তু ভোটের আসল পরীক্ষা কেমন করবে জাপা সে নিয়ে আলোচনা চলছে।
রাজনৈতিক মহল ও জাপার সাংগঠনিক অবস্থার বিচারে এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাপার শক্তি কমেছে। ভোটও কমেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র স্বৈরশাসক এরশাদ যিনি ক্ষমতা থেকে প্রবল জনরোষের মুখে বিদায় নেওয়ার দুই মাস পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে জনগণের ভোটেই সবটিতে জয়লাভ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি এবং প্রতিটি নির্বাচনে তিনি ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেন। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে পুনরায় প্রবেশের পর থেকে জাপার রাজনীতিতে এরশাদই মূল ফ্যাক্টর।
রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান এরশাদ। তার অনুপস্থিতিতে এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষিতে পিছিয়ে ছিল জাপা। নির্বাচন নিয়ে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে তারা বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘চাপে রাখার’ কৌশল শেষ পর্যন্ত সন্দেহের সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা এমন সন্দেহের কথা প্রকাশের পর জাপার দেনদরবারও গতি পায়। ফলে বিশ্লেষকরা বলেছেন, আসলে জাপা নিজের কৌশলে নিজেই চাপে পড়ে গিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছয় দফা বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত ২৬টি আসনে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এরশাদবিহীন জাপা। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি
থাকায় জাপাকে ২৯ আসনে ছাড়া দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আগেরবার ২০১৪ সালে এরশাদের সময় জাপা আরও বেশি ছাড় আদায় করতে পেরেছিল। ওই নির্বাচন দলটি ৩৪ আসন পায়। অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল ২২ আসন। ফলে এবার জাপা কয়টি আসন পায় তা নিয়ে আলোচনা আছে। কারণ আওয়ামী লীগ এবার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। জাপার এবারের দরকষাকষির অন্যতম ইস্যু ছিল এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাদের ছাড় দেওয়ার আসনে জয় নিশ্চিত করতে জাপা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রত্যাহার চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে রাজি হয়নি।
এর আগে সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা জিএম কাদের হঠাৎ করে গত ২০ আগস্ট ভারত সফরে যান। ভারত থেকে ফেরার পর তিনি অবস্থান পরিবর্তন করলেও বিভিন্নভাবে নির্বাচনে না যাওয়ার আভাস দিচ্ছিলেন। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মনোনয়ন বিক্রি শুরুর পরও জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছিলেন নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিশ্চিত নয়। বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনে যেতে তারা শাসক দল আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ৫০টি আসনে জয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছিল। সব মিলিয়ে দরকষাকষিতেও এরশাদের অভাব অনুভব করেছে জাপা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শামীম রেজা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুধু জাপা নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ফ্যাক্টর ছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে এরশাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল, ফলে ভোটের মাঠে জাপা সবসময় ভালো করত।’
এরশাদ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলই জাপাকে নিয়ে টানাটানি করত। এবারের নির্বাচনের মতো ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি। ফলে সেই নির্বাচনে এরশাদ ও তার দল জাপার অংশগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিয়ে যেতে এবং বিএনপি নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও দেনদরবার করেছিল। এমনকি এরশাদকে নির্বাচনে নিয়ে যেতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে দফায় দফায় বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী শিবিরেও জিএম কাদের ও জাপা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় তিনজন করে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী স্থান পেয়েছিলেন। এরশাদকে করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। কিন্তু জাপা সূত্রে জানা গেছে, এবার মন্ত্রিসভায় থাকতে জাপা যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটাও নাকচ করেছে আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দশম সংসদের মতো এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই আরও বেশি আসন না নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত হয়নি। দরকষাকষিতে জাপা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। স্বতন্ত্রই যদি থাকবে তাহলে আসন সমঝোতার দরকার কী, জাপার সিনিয়র অনেক নেতাকেই আসন ছাড়েনি সরকার। ঢাকায় কোনো আসন না থাকাও হতাশ করেছে তাদের। ২০০১-এর পর সবচেয়ে কম আসন পাওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানান এসব নেতা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবারের নির্বাচনে জাপার ভালো করার সম্ভাবনা কম। এমনকি সংসদের বিরোধী দলের আসনে জাপাকে হটিয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্ররা বসতে পারেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে জাপায় অস্বস্তি চলছে, যা ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে। সমঝোতার আসনে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্ররা প্রার্থী হওয়ায় জাপাকে চরমভাবে মূল্য দিতে হবে। সরকার জিতিয়ে নিয়ে না আসলে জাপার অধিকাংশ নেতাই হারতে যাচ্ছেন। আবার যে ২৬৫টি আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছে এর অর্ধেক আসনে জামানত হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন দলের নেতারা।
এবার জিএম কাদেরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং তার ছেলে সাদ এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেননি। ফলে দলের মধ্যে বিভেদ চলছে। রওশন অংশ না নেওয়ায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সাদ এরশাদ তার বাবা এরশাদের মৃত্যুর পর রংপুর-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এবার তিনিও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো সংযোগ না থাকায় তার প্রভাব রংপুরের মানুষের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এরশাদ যখন নির্বাচনী প্রচারণায় রংপুর বিভাগে যেতেন তখন সবাই ঘরের ছেলে মনে করে ভিড় জমাতেন। ভোট পেত জাপা। কিন্তু জিএম কাদের মানুষের সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত হতে পারেননি। এরশাদের মতো কোনো ফিগার জাপার রাজনীতিতে তৈরি হয়নি। শুধু রংপুর নয়, সিলেট ও ময়মনসিংয়েও এরশাদের ভালো জনপ্রিয়তা ছিল। দিনে দিনে তাও তলানিতে পৌঁছে গেছে। আওয়ামী লীগ জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেও জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের কবে প্রচারে নামবেন, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “‘মোগো ছাওয়া’ বলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে আবেগ ছিল, এরশাদের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। এরশাদ মানুষের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি করেছিলেন, যা ভোটের মাঠে কাজে দিত।” তিনি বলেন, ‘সুবিধাবাদের রাজনীতি করতে গিয়ে জাপা তাদের নিজস্ব সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। রাজনীতিতে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, অন্যান্য ছোট দলের মতো তারাও বিলীন হওয়ার পথে।’
এবার যে ২৬টি আসনে সমঝোতা হয়েছে তাতে রংপুরের ৩৩টি আসনের মধ্যে ৯টিতে জাপাকে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এই ২৬ আসনের মধ্যে ৩টিতেই রয়েছে জাপার ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। রংপুর-১ আসনে জিএম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ারের বিপক্ষে নির্বাচন করছেন জাপার বহিষ্কৃত মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। রাঙ্গা বর্তমান এমপি ও সাবেক মন্ত্রী। ফলে এখানে তার ভালো ভোট রয়েছে। নীলফামারী-৩ আসনে জাপা প্রার্থী রানা মোহাম্মদ সোহেলের বিপরীতে জাপার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী ফারুক কাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন তার শ্বশুর জাপার সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। আবার এই তিনটি আসনের প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। তবে দুটি আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। এর মধ্যে একটি রংপুর-৩ আসন, যেখান থেকে নির্বাচন করছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। আরেকটি হলো গাইবান্ধা-১ আসন, যেখানে জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে রংপুরের সমঝোতার বাকি সাতটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দুর্বল স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে- এমন আসন মাত্র তিনটি। এগুলো হচ্ছে ঠাকুরগাঁও-৩, কুড়িগ্রাম-১ ও কুড়িগ্রাম-২।
রংপুরের বাইরে কিশোরগঞ্জ-৩ থেকে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও নারায়ণগঞ্জ-৫ থেকে এ কে এম সেলিম ওসমানের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০১ সালে জাপা সর্বনিম্ন ১৪টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এবার সেই রেকর্ড জাপা ভাঙতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা।
এরশাদের অনুপস্থিতি অপূরণীয় বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘এরশাদের মতো নেতা জাপায় কেউ নেই। তার অনুপস্থিতিতে সারা দেশের মতো উত্তরাঞ্চলের ৩৩টি আসনেও দুর্বল হয়েছে জাপা। এবার যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে আমাদের ভালো ফলাফল করা কঠিন।’
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে জাপার দুর্গ ধসে গেছে অনেক আগেই। এরশাদ রাজনীতিতে একটা চরিত্র ছিলেন, তিনি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারতেন। কিন্তু তার ভাই জিএম কাদেরের মধ্যে সেই ক্ষমতা কম।’
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এরশাদ সাহেব ব্যক্তি হিসেবে ফ্যাক্টর ছিলেন। দেশ-বিদেশে তার বন্ধু ছিল। ফলে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করতেন। এবারের নির্বাচনে তার প্রভাব থাকবে, তিনি থাকলে হয়তো আমরা নির্বাচনে ভোটারদের বেশি সাড়া পেতাম। এরপরও ভালো ফলাফলের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’
জাতীয় পার্টি আছে অবৈধ হাসিনার পেড়ি কোর্ট এর নিচে